কত কত সেলিব্রেটি আছেন যে সমাজে, তারা নানা কিছু করে সেলিব্রেটি। তাদেরকে মানুষ আন্ধার মত অনুসরণ করে। তারা যা করেন, যে পণ্যের বিজ্ঞাপন করেন, যা করতে বলেন, মানুষ তা করতে অনুপ্রাণিত হয়।
এটা কেন হয়?
ধরা যাক, একজন ব্যক্তি অভিনয় করে, বা খেলাধুলা করে সেলিব্রেটি হইলেন। তাদের অভিনয় বা খেলাধুলা অনেক মানুষের ভাল লাগে। তারা বিনোদন দেন। কিন্তু তাই বলে, তাদের অন্ধের মত অনুসরণকারী কেন তৈরি হবে এবং কেন তারা মানুষ থেকে "সেলিব্রেটি" হয়ে যান? অনুসরণকারীরা কেন তৈরি হন বা সমাজ কেন তাদের বানায়।
আগের কালে মানুষেরা অনেক ধরণের দেব দেবীরে মানত, যেমন ইনকা সভ্যতায়, প্রাচীন মিশরে, গ্রিক, রোমান, দ্রুইদ, ভাইকিংস প্রায় সব প্রাচীন গ্রুপ ও সভ্যতায়। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে সেইসব দেব দেবীর উপর মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল কি না, এ নিয়ে আবার তর্কও আছে। কিন্তু দেব দেবী ছিল, তাদের নিয়ে গল্প ছিল, তাদেরকে মানুষ মানত। এই মানা নিয়ে ভায়োলেন্স ছিল, হিউম্যান স্যাক্রিফাইসও ছিল, সিলেটের জৈয়ন্তিয়া রাজ্য থেকে প্রাচীন মায়ানদের সভ্যতা পর্যন্ত।
আধুনিক সমাজের সেলিব্রেটি কালচার সেই দেব দেবীরে মানারই আধুনিক রূপ।
দেব দেবীদের পোলাপানেরা দেব দেবী হইতেন। তেমনি সেলিব্রেটিদের পোলাপানদের সেলিব্রেটি হওয়া সহজ। অন্যথায়, দেব দেবীদের কোন ভাবে বড় দেবতা যেমন জিউস, এদের সাথে কানেকশন থাকতে হইত। আধুনিক কালে এটা হইল অথোরিটি মিডিয়া, এরা তুলে ধরে সেলিব্রেটি বা আধুনিক দেব দেবী বানায়।
প্রাচীন দেব দেবীদের ক্ষেত্রে নানা গল্প প্রচলিত ছিল, এবং তাদেরকে মানুষ এক ভিন্ন এলিট স্তরে যেহেতু রাখত তাই তাদের বিষয়ে গল্পগুলাও হত ভিন্নরকম। যেমন, অনেক দেব দেবীর নানা রকম সেক্স করার গল্প, পরিবারের ভেতরে সেক্স করার গল্প বা ঈর্ষা এবং ইনফ্যান্টিসাইডের গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। আধুনিক দেব দেবী বা সেলিব্রেটিরে নিয়াও মানুষ এইরকম গল্প বানায়, শুনে ও বলে।
ধরা যাক দুনিয়ার সব মানুষ হঠাত করে মরে গেল একদিন কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের চিহ্ন রয়ে গেল। পরবর্তীতে কোন এলিয়েন সমাজ আসল ধরিত্রীতে। তারা এসে মরে যাওয়া মানুষদের কর্মকাণ্ড দেখতে লাগল, ফেসবুকে, মিডিয়ায়। অনেক অনেক লোক নিয়ম করে কিছু লোকের ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক পেইজ, টিকটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করত, আর রিয়েক্ট কমেন্ট করত।
দেখতে দেখতে তারা ধারণা করতে পারে, এই মানব সমাজ একধরনের লোকদের উপাসনা করত, এবং এদের ডাকত সেলিব্রেটি বলে, তাদের উপাসনার প্রক্রিয়া ছিল মুগ্ধ স্ক্রলিং, এবং তারও হাজার বছর আগে আরেক ধরণের মনুষ্য মূর্তিরে মানুষ উপাসনা করত, এদের মূর্তিতে গড় হয়ে প্রণাম করত বা নিয়মিত দিত পুষ্পস্তবক।
সেলিব্রেটিদের পক্ষ হয়ে মানুষ গলা ফাটায়। তাদের পক্ষে অনলাইন অফলাইনে যুদ্ধ করে। নিজের পয়সা ও ডেটা খরচ করে সেলিব্রেটিদের পক্ষের এই যুদ্ধ, সে সেলিব্রেটির দলে আছে, অর্থাৎ ঐ সেলিব্রেটির অন্যান্য ফ্যানের সাথে মিলেমিশে তাদের যে গ্রুপ আইডেন্টিটি, এর প্রকাশে।
যেকোন ভাবেই মানুষ গ্রুপে থাকতে পছন্দ করে। গ্রুপছাড়া হবার ভয় মানুষের প্রাচীন, একসময় গ্রুপ ছাড়া হলে, সেই জংগলী সমাজে, ব্যাপারটা ছিল মৃত্যু। এইজন্যই হয় খানকির পোলা গালি, যার অর্থ তুই সমাজচ্যূত, তর মা যেহেতু খানকি, তুই আমাদের গ্রুপের বাইরের। আমরা ভালো কারণ আমাদের মা বাপ স্বীকৃত, তারা সামাজিক সর্বজনসম্মত চুক্তির অধীনে সেক্স করে আমাদের জন্ম দিছেন।
গ্রুপে থাকা ও নিজের আইডেন্টিটি নির্মান। একেক দেবতার পূজারী হওয়ার ক্ষেত্রেও কি একই কারণ ছিল না? কেউ মানত দেবী এথেনারে, কেউ মানত হয়ত অন্য কাউরে। কেউ একজনের মুরিদ তো কেউ অন্য কারো মুরিদ।
একজনের মুরিদের সাথে অন্য জনের মুরিদের আবার বিরোধও হইত বা হয়, পীরমানা সমাজে। পীরাকি বা প্রচলিত পীরানুসারীদের যে সহনশীল বা কম ভায়োলেন্ট বলা হয় কিছু সেক্যুলার ন্যারেটিভে, উপমহাদেশের পীর ও তাদের অনুসারী সমাজের ইতিহাস এর পক্ষে স্বাক্ষ্য দেয় না।
আধুনিক সমাজে, মিডিয়ার পীর পীরানি বা দেব দেবী বা সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে, এদেরকে যে মানুষ অনুসরণ করে, এর উপর ভিত্তি করেই তাদের ক্ষমতা। এইজন্য তাদের হায়ার করে কোম্পানিগুলি বিজ্ঞাপনে কোম্পানির পক্ষে দালালী করার জন্য, কিংবা, তারা কখনো কোন ভালো সামাজিক কজের পক্ষে কথা বলেন, বা রাজনৈতিক দলেরা তাদের নির্বাচনের প্রার্থী করেন, প্রচারণায় ব্যবহার করেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইখানে নেগেটিভ দিকটা হল, অনেক সেলিব্রেটি ধ্বংসাত্মক মতবাদ, উগ্রপন্থা, রেসিজম, সাম্প্রদায়িকতারও পক্ষে যান এবং তাদের অনুসরণকারীদের সেই পথে প্রভাবিত করেন। খাদ্য পোশাক স্বাস্থ্য থেকে নানা বিষয়ে, কত কত খারাপ জিনিশ যে সেলিব্রেটিরা টাকা খাইয়া বা না খাইয়া সমাজে প্রচলিত করে রাখছেন, তার কোন লেখাজোঁকা নেই।
আমি যেহেতু ব্যক্তির অধিকার নিয়ে চিন্তা করি, ফলে আমার মনে হয়, এবং আমার ধারণা আপনারও মনে হবে যে, সেলিব্রেটিরা যখন সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রপন্থার সমর্থক হবেন প্রকাশ্যে, তখন সমাজে সাম্প্রদায়িকতা বাড়বে ও সংখ্যালঘু বা দূর্বল আক্রান্ত হবে।
এবং আরেক দিক, এতো এতো দেব দেবী বা সেলিব্রেটিরা এখন, ফলে তাদের প্রচুর অনুসরণকারী, সেই অনুসরণকারীদের নিয়ে কি ভাবা যায় না?
মানে, আমার মনে হয় সেলিব্রেটিরা ও তাদের অনুসরণকারীরা, উভয়েই মানুষ। হাজার বছর ধরে যে মানুষের বিবর্তন, হাজার হাজার প্রতিকূলতা, সংকট পেরিয়ে সেলিব্রেটির পূর্বপুরুষ যেমন টিকেছিলেন ধরায়, তেমনি টিকেছিলেন অনুসরণকারীদের পূর্বপুরুষ। তাই বৈজ্ঞানিক প্রাকৃতিক নির্বাচনের হিসাবে, মোটাদাগে, সেলিব্রেটির অনুসরণকারীরা একেবারেই আহাম্মক ও অথর্ব না চিন্তায়।
একজন অনুসরণকারীর কথা ভাবি। যিনি ধরা যাক, এক্স নামক সেলিব্রেটির ডাই হার্ড ফ্যান।
আরেকজন লোক, ধরা যাক সে সাধারণ, সে কোন দেব দেবীর পূজাতে নাই, নিজের পূজাতেই দিন যায়, অর্থাৎ নিজের কাজ কর্মে চিন্তায়।
সে বলল, সেলিব্রেটি চুদার টাইম নাই।
এতে সেলিব্রেটির ফ্যান ভাবল এ ঈর্ষায় এগুলা বলতেছে। সে উত্তরে বলল, সেলিব্রেটি কি তর চুদা খাইতে বসে আছে? সেলিব্রেটিরও তর চুদা খাবার টাইম নাই।
এই বলে বিরাট এক ছোট করা হল সে ভাবল, এবং মারাত্মক প্রতিশোধ নেয়া হল, তার সেলিব্রেটি দেবতার সম্মানের ভাবমূর্তিতে আঘাতের প্রতিবাদে।
কিন্তু সেই সাধারণ লোকটি এতে হাসল, সে বলল, এইজন্যই তো বললাম সেলিব্রেটি চুদার টাইম নাই। কারণ আমার চুদা খাবার টাইম তার নাই। আমি তার কাছে অনস্তিত্ব, তাহলে সে কেন আমার কাছে অস্তিত্ব হবে? সে তার কাজ করতেছে, করে হয়ত ভাল করতেছে, অনেক ফলোয়ার হইছে, ভালো, কিন্তু ইন্ডিভিজুয়াল হিশাবে তার কাছে আমি 'নাই' হইলে, কার্যকারণ ছাড়া সে কেন আমার কাছে "আছে" হবে? সেও আমার কাছে নাই, যেটারে সুন্দর করে বলা, সেলিব্রেটি চুদার টাইম নাই।
একজন মানুষের প্রধান কাজ হচ্ছে ব্যক্তি হিসাবে ইন্ডিভিজুয়াল হয়ে উঠা। অনুসরণকারী হয়ে জিন্দেগী পার করার জন্য কি হইছে এই মানবজন্ম?