ইউনুস এম্রে
ইউনুস এম্রে তুর্কি কবি ও সূফী। তাকে নিয়ে মুখে মুখে অনেক গল্প প্রচলিত তুর্কি কালচারে।
"আমি জানি না" ও গুরু শিষ্য সম্পর্ক
কাদি ইউনুস যখন সেলজুক সুলতানের বিচারকের পদ ছেড়ে দিয়ে তাপদুক এম্রের খানকায় যান ও তার শিষ্য হতে চান, তখনকার এই ঘটনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ইউনুস ছিলেন ইসলামি আইনের পণ্ডিত। বড় বড় শিক্ষকের কাছ থেকে শিখে, মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন শিক্ষা নিয়ে, কঠিন পরীক্ষায় পাশ করেই তিনি বিচারক হয়েছিলেন।
এ নিয়ে তার ভেতরে গর্ব ছিল। সরাসরি ইউনুস অহংকারী ছিলেন এমন না, কিন্তু তিনি মনে করতেন তিনি 'জানেন'।
তিনি ভেবেছিলেন তাপদুক এম্রে দরবেশ লজে তাকে হিসাব নিকাশ বা বিচারের কাজ দিবেন। তিনি নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে বলার চেষ্টা করেছিলেন যে আইন যেহেতু তিনি জানেন, যেহেতু তিনি বড় শিক্ষকের কাছে শিক্ষা নিয়েছেন অতএব হিসাব নিকাশের বা বিচারের কাজেই তার জন্য বেটার হবে।
বাস্তবিকই এটা, ইউনুসের চাইতে শিক্ষিত কেউ লজে ছিল না।
কিন্তু তাপদুক এম্রে তার শিষ্যকে প্রকৃত শিক্ষা দিতে চাইলেন, তাকে কাজ দিলেন খানকা পরিষ্কার করার, বলে দিলেন টয়লেট একটু ভালোভাবে পরিষ্কার করবে।
এতেও যখন ইউনুস বুঝতে পারলেন না যে তার "আমি জানি" একটা সমস্যা, তখন তাপদুক এম্রে তাকে কেবল, "আমি জানি না" বলার কাজ দিলেন। যে যাই বলুক, তিনি উত্তরে শুধু "আমি জানি না" বলতে পারবেন। আর কোন কথা বলা যাবে না।
তাপদুক এম্রে তার শিষ্যকে তৈরি করে নিচ্ছিলেন। তার দোষ কাটিয়ে নিচ্ছিলেন, যে দোষ উপস্থিত থাকলে কখনোই তার মোক্সা প্রাপ্তি হবে না।
ইউনুস অনেক পরে এই "আমি জানি না" এর মর্ম বুঝতে পারেন।
এখানে আরেকটা বুঝার মত জিনিশ, আধুনিক এক চিন্তা আছে গুরু শিষ্য বিষয়ে, যে যার কাছে গিয়ে আপনার নিজেরে বড় মনে হবে, সে নাকি ভালো বা বেটার গুরু। এটা আমেরিকান শিক্ষা, কালচারাল এক্সপোর্ট, কর্পোরেট কালচার থেকে আগত সম্ভবত।
তাপদুক এম্রের লজে শুরুতে ইউনুস ছোট হচ্ছিলেন, অপমানিত হচ্ছিলেন, ঠিক যেমন শুরুর দিকে স্টোয়িক গুরু জেনো লজ্জার মুখে পড়েছিলেন তার গুরু ক্র্যাটিসের মাধ্যমে। কিন্তু এই ছোট হওয়াগুলি দীর্ঘদিনে তাদের ভেতর জন্মানো কিছু দোষের আছর, ঐ দোষ না কাটালে যেই পথে তারা যেতে চাচ্ছিলেন, সে পথে তাদের পক্ষে সামনে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
—
উতুর ইউনুস, উতুর
ইউনুস এম্রে সিরিজে দরবেশ তাপদুক এম্রে দুনিয়াকে অন্যভাবে দেখেন। তিনি মনে করেন, যা ঘটছে তার এক উদ্দেশ্য আছে।
ইউনুসের প্রতি কিছুটা ঈর্ষায় ভুগতেন মোল্লা কাশিম। ইউনুসকে মেয়রের পরামর্শদাতার পদে দরবেশ পাঠিয়ে দিলেন, মনে মনে এই পদ আশা করেছিলেন মোল্লা কাশিম।
তিনি ইউনুসকে ঝামেলায় ফেলতে চাইলেন।
দরবেশকে গিয়ে মিথ্যা বললেন, আমার এক খালা আছেন গ্রামে, বৃদ্ধ, তিনি খবর পাঠিয়েছেন তাকে গিয়ে যেন দেখে আসি। তাই খানকা ছেড়ে কয়েকদিনের জন্য যেতে চাই। এই সময়ে এখানকার হিসাব নিকাশের জন্য আপনি ইউনুস এফেন্দিকে বলতে পারেন, শেখ।
তাপদুক এম্রে তাকে যাবার অনুমতি দিলেন। বললেন, হিসাব নিকাশের কাজ নিয়ে ভেবো না, সেটা দেখা যাবে।
পরে, তাপদুক এম্রে আঁচ করতে পারেন মোল্লার উদ্দেশ্য। তিনিও সকালে তার সাথে রওনা দেন। বলেন, আমিও দেখে আসি তোমার খালাকে।
মোল্লা মহা ফ্যাসাদে পড়েন। কারণ তিনি তো মিথ্যা বলেছিলেন।
অগত্যা, শেখকে নিয়ে গেলেন তার খালার বাসায়। তার খালা অন্ধ হয়ে গেছেন। বাড়িতে গিয়ে তারা দেখলেন আরেকজন লোক মোল্লা কাশিম পরিচয় দিয়ে তার খালার দেখভাল করছে, ও জায়গা জমি বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে।
সেই লোক তাদের দেখে, বিপদ বুঝতে পেরে একসময় পলায়ন করে। মোল্লা কাশিম তার খালাকে নিজের পরিচয় দেন, বলেন তিনিই আসল মোল্লা কাশিম।
তখন খালা বলেন, তুমি কি ভেবেছ যে আমি বুঝি নাই ওই ছেলেটা আসল কাশিম না? আমি অন্ধ হলেও বুঝতে পারি। কিন্তু আমার করার কিছুই ছিল না। সে আমাকে দেখাশোনা করত, আমার আর কেউ ছিল না। তাই আমি মেনে নিয়েছিলাম।
খালার ওখান থেকে ফিরতি পথে মোল্লা কাশিম তার ভুল বুঝতে পেরে শেখের কাছে মাপ চান। তখন শেখ বলেন, মাপ চাওয়ার কিছু নাই কাশিম। যা তুমি করেছ, উদ্দেশ্য খারাপ হলেও ফল খারাপ হয় নি। আজ আমরা না আসলে তোমার খালার সম্পত্তি ঐ লোক ধোঁকা দিয়ে নিয়ে নিত।
মোল্লা কাশিমকে শেখ লোভ সম্পর্কে শিক্ষা দেন। একটা কচ্ছপকে দেখে বলেন, কচ্ছপ দীর্ঘদিন বাঁচে কারণ সে আত্মসমর্পণ করেছে। সে তার পথে চলে। তার লোভ নাই। লোভ মানুষের জীবন খেয়ে ফেলে। কারো পদের লোভ, কারো সম্পদের লোভ, কারো নারীর, কারো খ্যাতির - এইসমস্ত লোভ উদ্ভূত জটিলতা তার জীবনীশক্তি খেয়ে ফেলে।
নানা সময়ে জটিলতার কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে ইউনুস শেখ তাপদুক এম্রের কাছে যান। গিয়ে তার সমস্যার কথা বলতে চান। তখন তাপদুক এম্রে বলেন, উতুর ইউনুস, উতুর।
মানে বসো ইউনুস, বসো।
তাপদুক এম্রের শিক্ষার এসেন্সই যেন এটা, বসো, শান্ত হও। ঘটনাকে ঘটতে দাও। সকল পথই এক পথ, সকল ঘটনাই এক ঘটনার সাথে যুক্ত। সত্য একটাই।
—
পরীক্ষা-
ইউনুস যখন এসে বললেন, শেখ, আপনি যখন আমাকে পাঠালেন প্রথমে আমারে পরীক্ষা করেছিলেন মেয়র। এরপর যে দায়িত্ব দিচ্ছেন তা নিয়েই ব্যস্ত আছি।
শেখ বলেন, হ্যাঁ অবশ্যই, পরীক্ষা তারা তোমাকে অবশ্যই করবে। এটাই এই মরণশীল দুনিয়ার প্রকৃতি। এখানে শক্তিশালী দূর্বলের পরীক্ষা নেয়, জালিম পরীক্ষা নেয় মজলুমের, ধনী পরীক্ষা নেয় গরীবের, মূর্খ পরীক্ষা নেয় জ্ঞানীর। যারা জানে তাদের জন্য এখানে পরীক্ষার ভেতরে পরীক্ষা, ইউনুসু।
—
আয়না -
শেখ তাপদুক এম্রে বলেন, হজরতে মুসা বলে গেছেন, হজরতে ঈসা বলে গেছেন।
তার কাছ থেকে যত বাক্য এসেছে, তা মূলত একটা জিনিশই উপদেশ দেয়।
নিজের জন্য এক আয়না খুঁজে নাও। আয়নার মধ্যে কোন খুঁত দেখতে পেলে, আয়না ভেঙে ফেলো না। তোমার মধ্যেই খুঁত আছে বুঝে নিও। আয়নার কী দোষ?
-----
ইউনুস ও রুমী -
ইউনুস এম্রে এমন একজন কবি, হাজার হাজার কবিতা তার নামে প্রচলিত, বলা হয়ে থাকে তার কবিতা নদীর মাছেরা জপত, পাখিরা উড়িয়ে নিত, বাতাসের ফেরেশতারা আবৃত্তি করতেন এবং বাকি অংশ ফিরত হাজারো মানুষের মুখে মুখে।
তার সম্পর্কে প্রচুর গল্প প্রচলিত আছে।
মওলানা জ্বালালউদ্দিন রুমী ও ইউনুস সমসাময়িক ছিলেন। রুমী মসনবী লিখেছেন, অন্যদিকে ইউনুসের কবিতা ছিল তুর্কি ভাষায় মুখে মুখে বলা ও ছড়িয়ে থাকা।
একবার ইউনুস ও রুমীর দেখা হল। রুমী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, মসনবী বিষয়ে আপনি কী ভাবেন?
ইউনুস বললেন, অতি উত্তম, অতি উৎকৃষ্ট! কিন্তু আমি হলে অন্যভাবে লেখতাম।
আশ্চর্য হয়ে রুমী জিজ্ঞেস করেন, সেটা কীরকম?
ইউনুস বলেন, আমি অনন্ত থেকে এলাম, রক্ত মাংসের পোশাক নিলাম, এবং নাম নিলাম ইউনুস।
এর উত্তরে রুমী বলেন, এতো অল্পে, সহজে সরাসরি বলতে পারলে, আমি অত বেশি লেখতাম না।
কথিত আছে ইউনুস সম্পর্কে মওলানা বলেন, আমি যখনই কোন আধ্যাত্মিক উচ্চমার্গে পৌছাই, দেখি যে ওইখানে এই তুর্কি সূফীর পদচিহ্ন, আমি তাকে পেছনে ফেলতে পারি না।
—-
আলীর হৃদয় যদি না থাকে তোমার, জুলফিকার পাইলে কী লাভ আর?
-শেখ তাপদুক এম্রে।
------
সম্মান -
ইউনুস যখন বিচারক হয়ে নালিহানে যান, তখন তার মধ্যে গর্ব ছিল। তিনি জানতেন যে তার শিক্ষা বেশি, জ্ঞান বেশি, এবং বিচারক হিশাবে তিনি সম্মানের যোগ্য।
সেইসময়ে একবার শেখ তাপদুক এম্রের খানকায় গিয়ে তল্লাশিও চালান।
পরে তিনি যখন বিচারকের পদে ইস্তফা দিয়ে তাপদুক এম্রের খানকায় যোগ দেন, নানা ঘটনা এবং অনেকদিন পরে, শেষবারের মত অপমানে যখন তিনি খানকা ত্যাগ করেন, তখন পথে পথে ঘুরছিলেন।
তার ভেতরে অশান্তি ছিল, কারণ তাপদুক এম্রে তারে বলেছিলেন ইউনুস, এতদিন এখানে থেকেও দুনিয়ার গন্ধ তোমার গেল না। ইউনুস বুঝতে পারছিলেন তার না পারা। দুঃখে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পথে পথে ঘুরছিলেন।
একসময় তিনি এক জঙ্গলে দুইজন লোকের দেখা পান। তারাও একইভাবে পথে পথে ঘুরছেন। তারা ইউনুসকে তাদের সাথে যেতে বললে ইউনুস রাজী হন।
গিয়ে তারা এক গুহায় আশ্রয় নেন।
লোক দুইজন বলেন, আপনার কাছে কি খাবার আছে?
ইউনুস বলেন, যে জানে না কোথায় যাবে তার কাছে খাবার থাকে কীভাবে।
তখন লোক দুইজন বললেন, তাহলে আসেন আমরা খাবারের জন্য দোয়া করি।
ইউনুস হাসলেন। কিন্তু দুইজন হাত তুলে দোয়া করতে লাগলে তিনিও হাত তুললেন।
এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলেন দোয়া শেষে একজনের সামনে খাবার।
পরে আবার দোয়া ধরলেন আরেকজন। তার সামনেও খাবার চলে আসল।
এবার লোক দুইজন ইউনুসকে বললেন, এবার আপনি দোয়া করে আপনার খাবার আনেন।
ইউনুস বলেন, এই জিনিশ তো আমি জানি না।
তখন তারা বললেন, তাও দেখেন চেষ্টা করে।
ইউনুস হাত তুললেন। ওই দুইজন লোকও হাত তুললেন। ইউনুস মনে মনে বলতেছিলেন, আল্লাহ আমার তো এই ক্ষমতা নাই। এনাদের সামনে শরম পাব, শরমের হাত থেকে বাঁচাও।
দোয়া শেষে দেখা গেল ইউনুসের সামনে দুইজনের খাবার এসে গেছে।
লোক দুইজন ইউনুসকে জিজ্ঞাসা করেন, কার নেকির কথা মনে করে আপনি দোয়া করলেন যে দুইজনের খাবার এসে গেল?
ইউনুস বললেন, আমি তো এমনিই দোয়া করছি। আপনারা কার নেকির উছিলায় দোয়া করেন?
তারা বলেন, আপনি কি নালিহানের তাপদুক এম্রের খানকা চিনেন?
ইউনুস বলেন, চিনি।
লোক দুইজন বলেন, ওইখানে একজন নেককার বান্দা আছেন, তার নাম ইউনুস এফেন্দি, আমরা প্রতিদিন তার নেকির কথা মনে করে দোয়া করি, আর আমাদের খাবার এসে যায়।
ইউনুস তখন মনে মনে বলেন, ইয়া আল্লাহ, এটা কি হইল, আমি শরমের হাত থেকে বাঁচতে চাইলাম আর তুমি আমারে সম্মানিত করে দিলা।
অতঃপর দুইজন লোক তাদের রূপ বদলে ইউনুসের রূপ নেন। তারা বলেন, যে সত্য তুমি খুজতেছ বাইরে, তা তোমার মধ্যেই আছে ইউনুস।
পরে ইউনুস ফিরে যান আবার তাপদুক এম্রের খানকায়।
দুইটা ঘটনা ইন্টারেস্টিং।
ইউনুস যখন কাদি ইউনুস হিশাবে নিজেরে সম্মানিত মনে করতেন, শিক্ষিত, সেলজুক সম্রাটের বিচারক, তখন তিনি প্রকৃত অর্থে সম্মানিত ছিলেন না। আর যখন ফকির হয়ে পথে পথে ঘুরছিলেন, নিজেকে তুচ্ছ ভাবতেন, ভাবতেন তিনি তার পীরের কথা মানতে পারেন নি, সত্য খুঁজে পান নি, তখন তিনি অলরেডি হয়ে গেছিলেন অনেক সম্মানিত।
তুর্কি সিরিজ ইউনুস এম্রে।