এক
একজন মানুষের মৃত্যুর পরে তার সাথে যা কিছু হয়, তা কি কোন ম্যাটার করে? বা, এইটা কি কোনভাবে এফেক্ট করে তার জীবনরে?
সাধারণ লজিক্যাল বস্তুবাদী দিক থেকে ম্যাটার করে না। কারণ মৃত্যুর পরে যেহেতু চেতনা থাকে না তাহলে তার সাথে কী হইল না হইল, তার কাজ কীভাবে লোকে বিচার করলো ইত্যাদি কিছুই যায় আসে না। ধর্মীয় পরকালের বিচার এখানে ধর্তব্য নয়।
হেরোডোটাসের বর্ননায় আছে সেই বিখ্যাত গল্প, একবার এথেন্সের জ্ঞানী আইনদাতা সোলন লিডিয়ার অসম্ভব ধনী রাজা ক্রোইসাসের রাজ্যে গিয়েছিলেন। সোলনকে পর্যাপ্ত আপ্যায়ন করার পর এবং তার ভ্রমণের বিস্তারিত কাহিনী শোনার পর, ক্রোইসাস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি এ পর্যন্ত সবচেয়ে সুখী মানুষ কাকে দেখেছেন?"
ক্রোইসাস মনে মনে আশা করেছিলেন সোলন তার নাম বলবেন, কারণ তার মত এত ধনী রাজা আর কে আছে। কিন্তু সোলন টেলাস নামে এক এথেনীয়ের নাম বললেন। হতবাক হয়ে ক্রোইসাস এই বিচারের কারণ জানতে চান।
তখন জ্ঞানী সোলন ব্যাখ্যা করেন, টেলাস একটি সমৃদ্ধ নগরে বাস করতেন। তার চমৎকার পুত্রসন্তান ছিল। তিনি বেঁচে থেকে তাদের সবার সন্তানাদি দেখে গেছেন। তার যথেষ্ট সম্পদ ছিল। তার গৌরবময় মৃত্যু হয়েছিল, শত্রুরা পরাজিত হওয়ার ঠিক মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি পড়ে যান। এথেনীয়রা তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছিল, যেখানে তিনি শহীদ হয়েছিলেন সেখানেই তার জন্য রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করেছিল।
অর্থাৎ, ক্রোইসাসের এখনো মৃত্যু হয় নি, এবং তাকে তার নাগরিকরা মরার পরে সম্মান দিতে পারে নি, সম্মানের সাথে মনে রাখে নি, অতএব, সোলনের বিচারে তিনি এখনো সুখী মানুষ না। 
সোলনের নীতিকথাটি ছিল, একজন মানুষ মরার আগে তাকে সুখী বলা যাবে না। 
এবং এর সাথে যুক্ত আছে, মরার পরে সে কীভাবে স্মরিত হবে। সোলন কোন ধর্মীয় পরকালের কারণের কথা বলেন নি, সাধারণ সেক্যুলার সেন্সেই ব্যাখ্যা করেছেন, সুখী মানুষের জন্য শেষের দুই পয়েন্ট দরকার তার বিচারে। 
দার্শনিক পিটার সিংগার এর অসাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার থিংকিং এবাউট ডেড [ Thinking About the Dead, Peter Singer] - প্রবন্ধে, একটা থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে, 
ধরা যাক আপনি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। আপনার কলিগ একদিন জানালেন তার দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে, তিনি মাত্র এক বছর বাঁচবেন। তিনি ছুটি নিয়ে চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, তিনি দশ বছর ধরে যে গবেষণা করছিলেন, তার উপর বই লিখবেন। এটাই হবে তার জীবনের সেরা কাজ। 
তিনি চলে যাবার প্রায় এক বছর পরে আপনি তার একটা ফোনকল পেলেন, তিনি দেখা করতে চান। আপনি তার বাসায় গেলেন। তখন তিনি বললেন, আর কয়েকদিন মাত্র তিনি বাঁচবেন। বই শেষ হয়েছে। সেরা একটা কাজ হয়েছে। আপনি কি তার বইয়ের জন্য প্রকাশক খুঁজবেন ও প্রকাশ করে দিবেন? তিনি অনুরোধ করলেন। আপনাকে অনুরোধ করে, আপনার হাতে বই সঁপে দিয়ে তিনি প্রশান্তির চোখে তাকালেন। 
আরো কিছু কথাবার্তার পরে আপনি বিদায় জানিয়ে চলে আসলেন। পরদিন সকালে খবর পেলেন ওই রাতেই তিনি মারা গেছেন। 
আপনি তার বইয়ের পাণ্ডুলিপি খুলে দেখলেন। বইটি ভালো, কিন্তু খুব অসাধারণ কোন কাজ না। না প্রকাশ করলেও চলে। এরকম আরেকটা বই প্রকাশ করে কি লাভ, বই প্রকাশ হোক বা না হোক, তার তো কিছুই আসে যায় না, সে মরে গেছে। এই বলে আপনি বইটি ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। 
এখন, প্রশ্ন, বই এভাবে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আপনি কি কোন নৈতিক ভুল করলেন?  তার প্রতি কোন অন্যায় করলেন? তার জীবনরে আপনি আরেকটু কম অর্থবহ করে তুললেন? বইটি প্রকাশ করলে তার গত জীবন কি আরেকটু অর্থপূর্ন হয়ে উঠত? 
যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে, মরার পরে মানুষের সাথে যা ঘটে, তাও ম্যাটার করে। এর জন্য কোন পরকাল বা ধর্মীয় ব্যাখ্যারও প্রয়োজন নেই। 
এই কাহিনীটা ও ব্যাখ্যা দিলাম, কারণ বাংলাদেশে একটা খুবই জঘন্য ঘটনা ঘটেছে। নুরাল পাগলা নামে এক ব্যক্তির মৃতদেহ কবর থেকে তুলে জ্বালিয়ে দিয়েছেন "তৌহিদি জনতা"। দেইখাই মনে পড়লো আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের কবর আক্রমণের কথা উঠেছিল। এই দুই বিষয় সম্পর্কিত না আপাত দৃষ্টিতে - কিন্তু অন্যভাবে দেখলে - দুইটাতেই মৃতদেহরে অসম্মান করার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ হয়।
একটা জাতির ডেকাডেন্স তথা মরাল কালচারাল অধঃপতন সর্বনিম্ন স্তরে যাইতে থাকলে সম্ভবত এই ধরণের উপসর্গ দেখা দেয়।
সব কালচারেই মৃতদেহরে সম্মান করার রীতি আছে, প্রাচীন গ্রিক কালচারেও ছিল। এজন্য প্রতিশোধ ও ক্রোধে উন্মত একিলিস যখন বীর হেক্টরের মৃতদেহের পায়ে দড়ি বেঁধে তার রথের পেছন পেছন টেনে নিয়ে যায় - ট্রয়ের প্রাচীরের চারদিকে তিনবার ঘুরায় - পেট্রোক্লাসের সমাধির চারদিকে হেক্টরের মৃতদেহ টানতে থাকে ১২ দিন ধরে - তখন ওইটা ছিল গ্রীক কালচারের প্রতি চূড়ান্ত অসম্মান এবং সর্বনিম্ন পতন। দেবতারা ক্ষুব্ধ হন, জিউসের হস্তক্ষেপ করতে হয়, পরে রাজা প্রিয়াম যান সন্তানের লাশ আনতে এবং এরপরে মানবিক দৃশ্যের তৈরি হয় যেখানে ক্রোধ থেকে বের হইয়া একিলিস বুঝতে পারে সে ভুল করছে।
প্রায় একইরকম মৃতদেহ অসম্মানের জটিলতা সফোক্লিসের এন্টিগোনিতেও দেখা যায়। পলিনিসিস তার ভাই ইতিওক্লিসের সাথে যুদ্ধে থিবিসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, পরে রাজা ক্রিয়ন বলেন, পলিনিসিসের মৃতদেহ পড়ে থাকবে। শেয়াল শকুনে খাবে, কেউ যেন সৎকার না করে। এন্টিগোনি ভাইয়ের মৃতদেহ সৎকার করতে এগিয়ে আসে, রাজার আদেশ সে অমান্য করে। তারে রাজা মৃত্যুদণ্ড দেয়। এন্টিগোনি আত্মহত্যা করে, তার প্রেমিক রাজা ক্রিয়নের পোলা আত্মহত্যা করে, ক্রিয়নের স্ত্রী ইউরিডিসি আত্মহত্যা করে, এবং পরে ক্রিয়ন অনুশোচনা করতে থাকে। অর্থাৎ, এই মৃতদেহরে অসম্মানের শাস্তি দেখানো হয়েছে।
দুইটা জায়গাতে, জিজ্ঞেস করেন, কেন তারা মৃতদেহরে অসম্মান করতে গেছিল? প্রতিশোধ, রাগ, ক্ষোভ। রাজা ক্রিয়নের ক্ষেত্রে, কঠোর আইনের নিয়ম প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি, দেশপ্রেমিক ইতিওক্লিসের মৃতদেহকে সম্মানিত ও পলিনিসিসের মৃতদেহকে অসম্মানিত করে দেশদ্রোহিতার শাস্তি দেখানো, যাতে পরে আর কেউ না করে।
এখন আমাদের দুই বিষয়টাতে দেখি। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ এটাকের কথা উঠেছিল, কারণ যারা এটাকপন্থী তাদের মত মুজিববাদীরা দেশের শত্রু, ফ্যাসিবাদী, ও দেশের শত্রু। ফলে তাদের নির্মূল করতে হবে, এবং এর জন্য তার মৃতদেহ তথা কবর অসম্মান করাই যায়। তারা করছেন বলতেছি না, কিন্তু এমন পোস্ট, উসকানি দেখা গেছে।
আর নুরাল পাগলার মৃতদেহের ক্ষেত্রে, একরকম পার্সোনাল ক্ষোভ, সে আমার ধর্মরে অসম্মান করছে, ভুল তরিকা প্রতিষ্ঠা করে মানুষরে বিপথে নিতেছে, নিজেরে ইমাম মাহদি দাবী করতেছে। ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া তৌহিদি জনতা তাদের এগ্রেশনরে জাস্টিফাই করেন।
আমি এইসব মাজার কেন্দ্রিক যেই ব্যবস্থাটা আছে, তারে খুব উদার কিছু মনে করি না। মানুষের সাইকোলজিক্যাল নানা দূর্বলতা কাজে লাগিয়ে এরা সাধারণ মানুষরে ব্যবহার করে। নিজেদের ইনফ্লুয়েন্স, ক্ষমতা বাড়ায়। অর্থ বিত্ত এবং নানাদিকে লাভবান হয়। এইসব কুসংস্কার ও ভণ্ডামিরে প্রশ্রয় দেয়ার কিছু নাই।
কিন্তু, কোন ব্যক্তির মৃতদেহ দলবেঁধে উঠিয়ে তারে পাবলিক অসম্মান করারে একটা চরম খারাপ, নিম্নতম এক পয়েন্ট হিশাবেই দেখতেছি। এই প্রবণতা, এবং যেই ক্রোধ, ক্ষোভ এই প্রবণতার দিকে নিয়া যাচ্ছে, তারে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। সবচাইতে ভালো হয়, একিলিসের মত তাদের রিয়ালাইজেশন আসলে। কিন্তু আমরা দেখছি যে, একিলিসেরো নিজ থেকে আসে নাই উপলব্ধি, বাইরে থেকে দেবতাদের হস্তক্ষেপ করতে হইছে, রাজা প্রিয়ামরে যাইতে হইছে। ক্রিয়নের ক্ষেত্রে, ট্রাজেডির ভেতর দিয়া যাইতে হইছে, এটি মূলত ক্রিয়নের পতনের ট্র্যাজিক কাহিনী। আমি চাইনা এই জাতি ট্রাজেডির ভেতর দিয়া গিয়া বুঝুক।
দুই
নুরাল পাগলের ইস্যুটা সিরিয়াস, কিন্তু এই বিষয়ে বেশী কথা হইতেছে না। সবচাইতে ডেঞ্জারাস অবস্থা হইল, যখন মানুষেরা নাম্ব হয়ে যায়। কোন কিছু তার লাগে না, বা লাগলেও দ্রুত ভুলে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার এই সময়ে সেটা হয়ে দাড়াইছে দ্রুত এক ইস্যু থেকে অন্য ইস্যুতে চলে যাওয়া এবং কোন কিছুরই গভীরে না যাওয়া। তবুও তার মনে হবে সে সকল কিছুতেই আছে।
নুরাল পাগল ধরণের মানুষ এই দেশে অনেক আছে। ভক্তিবাদ এই অঞ্চলের মূল মতবাদ, কারণ সারফেইস লেভেলের ভক্তিবাদ সহজ - অলস ও কম বুদ্ধির লোকদের জন্য আরামদায়ক আধ্যাত্মিক পলায়নপরতা। ফলে, নুরাল পাগল ধরণের লোকদের অনেক ভক্ত জুটে যায়।
কখন মানুষ কখন নিজেরে ইমাম মাহদী, নবী বা আল্লাহরে দেখছে ইত্যাদি দাবী করতে পারে? যখন ডিলিউশন হবে, স্কিজোফ্রেনিয়ার জন্য সাইকোটিক ডিজঅর্ডারের কোনো পর্যায়ে এই ধরণের বিভ্রান্তি হতে পারে ব্যক্তির। এখানে ওই ব্যক্তির কোন দোষ নাই। সে তার মানসিক অবস্থার কারণে নবীরে দেখতেছে, আল্লাহরে দেখতেছে বা সে যে ইমাম মাহদী এই বিষয়ে চিহ্ন দেখতেছে। যেসব জিনিশ তার কল্পণায় আছে, ওইগুলা বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে তার কাছে। ফলে সে কনফিডেন্টলি বলতে পারছে, আমি ইমাম মাহদি, আমি নবী অমুক ইত্যাদি।
এদের মধ্যে অনেকে হইতে পারে ভণ্ড, ইচ্ছা করে স্বার্থের জন্য অভিনয় করে। কিন্তু অনেকে থাকে মানসিক ঐসব অবস্থার শিকার।
তার চিকিৎসা দরকার। সে চিকিৎসা নিতে না চাইলে, সমাজের হার্মফুল না হইলে, সে তার তার মত থাকুক। এবং, আমাদের দেশে এসব চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থাও নাই। ১৭০ মিলিয়ন মানুষের দেশে, ২০১৯ সালের বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক ব্যাধির সামগ্রিক প্রকোপ ১৮.৭% পাওয়া গেছে, স্কিজোফ্রেনিয়া স্পেকট্রাম ১%। অর্থাৎ ১৭ লক্ষ মানুষ।
স্কিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে ডিল্যুশন হইতে পারে ৬৫% বায়োলজিক্যাল সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত এই গবেষণা মতে, অর্থাৎ আমরা ধরতে পারি দেশে প্রায় ৫ থে ৬ লক্ষ লোকের এই বিভ্রান্তি হইতে পারে যে - সে কোন পীর, নবী, ইমাম মাহদি, আল্লাহরে দেখছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সে যখন আসলেই দেখতেছে তার মত করে, তখন সে কনফিডেন্টলি বলবে। তার ওইটা তো মিথ্যাও না, তার ব্রেইন তারে দেখাইতেছে।
আপনারা খেয়াল কইরা দেইখেন মাজারে মাজারে কোন ধরণের মানুষেরা থাকেন।
এদের ট্রিটমেন্টের তো ব্যবস্থা নাই, অধিকার নাই, উলটা ধর্মীয় কট্টর পন্থী ওয়াজ প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে অনেক লোক আগ্রাসী অবস্থানে চলে গেছে। নুরাল পাগলার কবর ও মৃতদেহকে অসম্মান এর এক সরাসরি ফল।
কিন্তু উদার ও মানবিক ভাবে ধর্মরে ব্যাখ্যা করলে, তারা বলতেন, এরা মাজনুন, যে তিন ধরণের ব্যক্তিদের উপর থেকে আইন উঠিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের অন্তর্গত।
এতে মানুষের ভেতরে টলারেন্স বাড়তো। এই টলারেন্স শত শত বছর ধরে এইখানে ছিল।
টলারেন্স ব্যতিরেকে রাষ্ট্র টিকাইয়া রাখা যাবে না।



এটা পড়তে গিয়ে “অপরাধবোধের প্রয়োজনীয়তা” লেখাটার কথা মনে পড়ে গেলো, সম্ভব হলে লেখাটি সাবস্টেকে পুনঃপ্রকাশের অনুরোধ থাকলো।