বাংলাদেশ তার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে ব্লকচেইন প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করবে, এর একটা রোড ম্যাপ, ন্যাশনাল ব্লকচেইন স্ট্র্যাটেজি [১], প্রকাশ করেছে ২০২০ সালে। সেখানে কৃষি, জুডিশিয়ারি, রেমিটেন্স, পেনশন, পেমেন্ট, ভ্যাট, ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে কীভাবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে এর আপাত আলোচনা আছে।
মানুষের সভ্যতা কৃষি পূর্ব ধাপ, কৃষি ধাপ, শিল্প বিপ্লবের ধাপ পার হয়ে এখন প্রবেশ করছে তথ্য প্রযুক্তির ধাপে। যত দিন যাবে, আমরা দেখতে পাব ইন্টারনেট প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমতা, ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লকচেইন এর ব্যবহার বাড়ছে।
বাংলাদেশের ব্লকচেইন রোড ম্যাপটা সাধারণ ভাবে এরকম,
২০২১-২২-২৩ থেকে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন, আইডেন্টিটি ইনফাস্ট্র্যাকচারে ব্লকচেইন ব্যবহার।
২০২৩-২৪ থেকে ভূমি ব্যবস্থাপনায়।
২০২৫ থেকে কৃষিতে।
২০২৮ এ স্বাস্থ্য সেবার সাপ্লাই চেইনে।
২০৩০ থেকে স্মার্ট সিটি ও বিচার বিভাগে।
এই প্রসঙ্গে ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার নিয়ে সাধারণভাবে লেখা যায়। লেজার মানে এখানে ধরেন হিসাবের খাতা।
এক গ্রামে কিছু লোক ছিল। তারা জিনিসপত্র আদান প্রদান করত, এবং তাদের এই বেচাকেনার হিসাব প্রথমে রাখতেন এক গ্রামের মুরুব্বি। কারণ তখনো লেখা আবিষ্কার হয় নি।
কিন্তু দেখা গেল মুরুব্বির স্মৃতির উপর নির্ভর করা যায় না সব সময়। ঝামেলা হয়। ইতিমধ্যে এক অবিশ্বাস্য প্রযুক্তি একজন বের করে ফেলেছে। গাছের ছাল বাকলে লিখে রাখার প্রযুক্তি।
এই জিনিশ পুরা হিসাব রাখার পদ্বতিটাকেই বদলে দিল। এরপর থেকে মানুষ ছাল বাকলের খাতায় হিসাব রাখতে শুরু করল।
কিন্তু এখানেও কিছু সমস্যা রয়ে গেল। মহাজন টাকা ধার দিছে ১০ হাজার। ৫ বছর পরে এসে বলে, টাকা ফেরত দিতে হবে ৫ লাখ। সুদে আসলে নাকি এত বেড়ে গেছে। অসহায় কৃষক বাধ্য হয় তার বন্দকী জমিটা ছেড়ে দিতে।
এই হিসাবের খাতার সমস্যাটা ছিল, এখানে দুই পক্ষের মধ্যে, ক্ষমতাবান পক্ষ তথা মহাজনের নিয়ন্ত্রণ ছিল খাতার উপরে।
ধরা যাক আপনি এখন আমাকে পেপালের মাধ্যমে ৫০ ডলার পাঠালেন। আমি সাথে সাথে ৫০ ডলার পেয়ে গেলাম। এই যে আমি পেলাম, ও আপনি পাঠালেন, এই টাকা কি প্লেনে করে আমার কাছে ফিজিক্যালি এসেছে? না।
এটা এসেছে হিসাবের খাতায়। সংখ্যা হিসেবে, চুক্তি হিসেবে। পেপালকে আপনি বলেছেন আমি অমুককে ৫০ ডলার দিলাম। পেপাল সেটা বাস্তবায়ন করল, আপনার হিসাব থেকে বিয়োগ করে, আর আমার হিসাবে যোগ করে।
বা, আমি যখন কোন স্টক কিনলাম, স্টকের সার্টিফিকেট কি আমার কাছে আসে? না।
বরং, এটা একটা চুক্তি বা হিসাবের সংখ্যা, তথা তথ্য হিসাবে থাকে।
এমনকি ডিজিটাল আইডেন্টিটিও তথ্য হিসাবে থাকে। ধরেন, ফেইসবুক আইডি একজনের, এটা ফিজিক্যাল ব্যক্তি না, তার কিছু তথ্য আমরা দেখি, এই তথ্য হিসাবেই তার অবস্থান।
হিসাবের খাতায় এইসব তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণত, যখন ব্যাংক ও একটি বিজনেস প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করল, তখন দুই পক্ষেই দুইটা হিসাবের খাতা থাকে। একইভাবে দেশে দেশে বিজনেস, দুই পক্ষই হিসাব রাখে। এইসব ভিন্ন ভিন্ন লেজারে গরমিল থাকতে পারে। এবং এইসব খাতাতে হিসাব তুলতে, চেক রিচেকে সময় লাগে। এবং এইখানে বেড়ে যায় ফি।
কিন্তু এরকম যদি কোন সিস্টেম হয় যে, সবারই একটা হিসাবের খাতা থাকবে। খাতাটি থাকবে একটা নেটওয়ার্কে, যেখানে অংশগ্রহণকারী পক্ষরা যুক্ত থাকবেন, এবং তারা এই খাতাটি দেখতে পারবেন?
এটাই ডিস্ট্রিবিউটেড লেজারের ধারণা।
এতে আদান প্রদানে সময় কমে যায়, ফি কমে যায়, এবং সব পক্ষের কাছে হিসাব থাকায় স্বচ্ছতা বাড়ে।
যেহেতু ডিস্ট্রিবিউটেড হিসাবের খাতায় অর্থাৎ ব্লকচেইনে সকল আদান প্রদানের তথ্য থাকবে, এবং সবার সংযুক্তি থাকবে, তাই কেউ ভুল তথ্য দিলে তা যুক্ত হবে না, রিজেক্ট হবে, কারণ এই তথ্য অন্যদের সাথে মিলবে না।
বিভিন্ন দেশ মেডিকেল, সাপ্লাই চেইন, সরকারি ফান্ডিং, ব্যাংকিং, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৃষি সাপ্লাই চেইন, সরকারী ফান্ডিং এ ব্লকচেইন প্রযুক্তি ভালোভাবে ব্যবহার করা গেলে এসব জায়গায় যে বড় দূর্নীতি হয় তা বন্ধ করা সম্ভব।
সরকারী ফান্ডের একটা সমস্যা হল, যে কাজের জন্য টাকা দেয়া হয়, ওই কাজে অল্প টাকাই যেতে পারে। বাকি অংশ পথে নাই হয়ে যায়। কিন্তু একটি ওপেন হিসাবের খাতায় যদি লেখা থাকে আদান প্রদানের তথ্য, এবং কাজে কত ব্যবহৃত হল সেই তথ্য, এবং এই খাতা যদি পাবলিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখতে পারে তাহলে ব্যাপারটা স্বচ্ছ হয়ে উঠবে।
অনেক ক্ষমতাবান মানুষের বড় স্বার্থ জড়িত এখানে। বাস্তবতার বিচারে এর বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। কিন্তু সম্ভব।
ডিজিটাল আইডেন্টিটি ম্যানেজমেন্টেও ব্লকচেইন কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলাদেশে। ডিজিটাল আইডি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে, যেমন এটি রাষ্ট্রকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ নিতে সাহায্য করে এমন। কিন্তু কভিড-১৯ ক্রাইসিস এর প্রয়োজনীয়তাও দেখাতে পেরেছে। ইতালিতে বেকার ভাতার ব্যবস্থা ক্র্যাশ করেছিল, আর এদিকে সরকারী অফিসও তখন বন্ধ। আমেরিকাতে ওয়াশিংটন রাজ্যের ৬৫০ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নিয়ে গেছে চুরি করা আইডেন্টিটি দেখিয়ে। এগুলি প্রমাণ করতে পেরেছে একটা শক্ত ডিজিটাল আইডেন্টিটি ম্যানেজমেন্ট দরকার রাষ্ট্রের। ইউরোপের দেশ এস্তনিয়াতে এমন ভালো ডিজিটাল আইডেন্টিটি ব্যবস্থা থাকায় তাদের ইতালি বা আমেরিকার মত সমস্যায় পড়তে হয় নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিজিটাল আইডি ব্যবস্থাপনা অনেক বুরোক্রেটিক অর্থহীন কাজ এবং ব্যয় কমিয়ে ফেলে জনগণের দুর্ভোগ কমাতে পারে। আবার একইসাথে এটা ভালো ভাবে মনে রাখা দরকার যে, এমন ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করে সরকার ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর বাহিনী মানুষকে হয়রানি করতে পারে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই আগে, এগুলি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, কোন প্রেক্ষিতে কার এক্সেস থাকবে তা গণতান্ত্রিক পদ্বতিতে আইন করে ঠিক করা জরুরী। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে, ভারত সরকারের একটা ইচ্ছা থাকা অস্বাভাবিক নয় যে, বাংলাদেশ সরকারকে ডিজিটাল আইডেন্টিটি স্ট্র্যাকচার নির্মানে সাহায্য করা, তাদের আধার প্রযুক্তির সাহায্যে এবং তার মাধ্যমে সরকার টু সরকার তথ্য আদান প্রদানের চুক্তিতে যাওয়া। ভারতে বাংলাদেশীরা অনুপ্রবেশ করছে, এই সমস্যাটি রাজনৈতিক মহলে আলোচিত হয়। তারা এই অনুপ্রবেশের সমস্যা সমাধান করতে তথ্য আদান প্রদানের সমঝোতায় যেতে চাইতে পারে, কিন্তু এটি দিনশেষে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, এটি নিরঙ্কুশ ভালো কখনোই হয়। কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ন্ত্রণের কী কী উপায় রাখা হচ্ছে, এগুলির উপর নির্ভর করে কেমন প্রভাব পড়বে সেই প্রযুক্তির।