মনারে মনা কোথায় যাস নামে একটা বিখ্যাত ছড়া আছে, লেখক আহসান হাবীব, যেইটা আমরা পড়ছি ছোট বেলায়। এই ছড়ায় মনা এক পোলা বিলের ধারে ঘাস কাটতে যায়। সে বলে ঘাস বিক্রি করবে হাটে। তারপর চিকন সূতার জাল কিনবে, মাছ মারবে, মাছ বেঁচতে, এবং সেই টাকা দিয়া সে বোনের জন্য শাড়ি ও মার জন্য হাঁড়ি কিনবে।
এই জায়গায় জিজ্ঞেস করা যায়, তাইলে মনা তার বউয়ের জন্য কী কিনবে?
বলা যায়, মনার তো বউ নাই। কিন্তু নাই বলে যে তার বউ হবে না এমন তো না। এবং এই জায়গায় সমস্যাটা হবে, যখন মনার বউ মনারে তার মা ও বোনের জন্য এই জিনিসগুলি কিনতে দিবে না। সে বাঁধা দিবে।
কেন বাঁধা দিবে?
ব্যক্তিগত চারিত্রিক বিষয় আলাদা করে রাখি, ওইটা ব্যক্তি ও অবস্থা সাপেক্ষে ভিন্ন হয়, সামষ্টিক আলাপ করি। মনার বউ জানে যে, মনা ছোটবেলায় বইয়ে পড়ছে মাছ বেচার টাকায় মারে হাড়ি ও বোনরে শাড়ি দিতে হয়। ফলে, একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে সে। তাই মনা ঘাস কাটতে গেলেই সে আগে থেকে জানাইয়া দিবে এইসব শাড়ি হাড়ি কিনা যাবে না, টাকা জমাইতে হবে। সে হয়ত ভাববে মনা একটা স্টুপিড। এইজন্য নিজের বুঝ বুঝে না।
এই ছড়া একটা গুড নীতিশিক্ষা দেয়, উপরিউক্ত কমপ্লিকেটেড সামাজিক সমস্যা বা অবস্থা ব্যতিরেকেও। সেটা হইল মনার ফ্যামিলির প্রতি কমিটমেন্ট। মানুষের লাইফরে হ্যাপি করে কমিটমেন্ট। মনার এই পারিবারিক কমিটমেন্টের জায়গা, তাদের জন্য তার স্বার্থহীনতা, একটা ভালো শিক্ষাই। কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপটে, বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে অত ভালো না বিষয়টা। যেমন, ফ্যামিলির স্বার্থ দেখতে থাকলে সবাই, এটা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যহত হয়। এইটা হয় মাফিয়া সিস্টেমে, যেখানে ফ্যামিলির প্রতি কমিটমেন্টই মূল। পুটনাম সাহেব,(মেকিং ডেমোক্রেসি ওয়ার্ক, ১৯৯৩) সাউথ ইতালিতে এই সমস্যা আছে দেখাইছিলেন, এবং তার মত দিছিলেন এই কারণেই নর্থ ইতালি থেকে তারা অনুন্নত। তার হিসাবরে গুরুত্ব দিয়া দেইখাই আমরা মনারে বলতে পারি, সে যেন সব টাকা দিয়া হাড়ি আর শাড়ি না কিনে। কিছু যেন জমায় বা অন্য কাজে লাগায়। এবং তার যেন ফ্যামিলির বাইরেও কমিটমেন্টের জায়গা থাকে।
এবং একটা ফাইনানশিয়াল পরামর্শও মনারে দেয়া যাইতে পারে। যদিও মনা খুবই রেসপেক্টেবল ক্যারেক্টার। সে দায়িত্ব নিছে। পিটার প্যান সিন্ড্রোমে ভুগা হিমু না সে। তারে এই রেসপেক্ট দিয়া, তার কাজ ঘাস কাঁটা মাছ ধরা ও এগুলা বিক্রি, এই উদ্যোক্তা স্পিরিটরে সম্মান দেখাইয়াও বলা যায়, ওয়েলথ হইল মনা, যে হাঁড়ি তুমি কিনো নাই, যে শাড়ি তুমি কিনো নাই, যে গাড়ি কিনো নাই, যে জুয়েলারি কিনো নাই। ওয়েলথ মানে খরচ না, ওয়েলথ হইল অপরচুনিটি, তোমারে যে জিনিশ বেশি অপরচুনিটি দিয়া স্বাধীনতারে বাড়ায়। মনা তোমার এক মিলিয়ন ডলার আছে, এইভাবে ভাবলে হবে না তুমি এইটা খরচ করতে পারবা। এই জিনিশ ওয়েলথ তখন যখন সেইটা বুঝায় ১ মিলিয়ন ডলারের সুযোগ তোমার আছে, এই টাকা না থাকলে যেসব সুযোগ থাকত না, সেগুলা তোমার আছে। তুমি অর্থনৈতিক ভাবে বেশি স্বাধীন। বেশীরভাগ লোকে এক মিলিয়ন ডলারের মালিক নিজেরে চিন্তা করলে ভাবে কীভাবে সে খরচ করবে তা দিয়া। কিন্তু দুইটা দুই জিনিশ মনা।
ফলে শাড়ি হাড়ি অবশ্যই মেটার করে। মারে, বইনেরে দিলে, তাদের যে আনন্দ, বা নিজের দেয়ার যে আনন্দ, এইগুলার কোন মূল্য হয় না। কিন্তু মনা, এই চক্র অবিরত চলতে থাকলে তা শুধু খরচের দিকে যাবে, তুমি ভাববা খরচই ওয়েলথ। আর আধুনিক সমাজে নিয়ারলি এভ্রিথিং, তোমার কাছে তাদের জিনিশ বেঁচতে চায়। তোমার কষ্টে অর্জিত টাকা তাদের গোলায় নিয়া ভরতে চায়। ফলে টাকা অর্জন হইল জিনিশ কেনার জন্য, এইটা বাজে অর্থনৈতিক শিক্ষা, তুমি এইটা না শিখো। শিখলে হয়ত তোমারে এইভাবে কাজ কইরাই যাইতে হবে সারাজীবন।
কয়েকটা বিষয় এই লেখায় আসছে, যা অন্য লেখায় বিস্তারিত আছে, সেসব লেখার লিংক এখানে যুক্ত হইল আগ্রহীদের জন্য–
১। পুটনাম সাহেবের রিসার্চ, ও আকবর আলি খানের গবেষণার ভিত্তিতে বাংলাদেশের গরিবী বিষয়ক অনুসন্ধান।
৩। জীবনের মিনিং কী, এ নিয়া অডিসির লাইফ ও মিশন বিষয়ক লেখা।