নবম শতকের গুরু শেইজেন ইশিন বলছিলেন, ত্রিশ বছর আগে যখন আমি জেন শেখা শুরু করি নাই, তখন বললাম, পাহাড়গুলা হইল পাহাড়, এবং জলাধার হইল জলাধার।
একজন বড় জেন সাধুর কাছ থেকে জেনের শিক্ষা পাবার পর বললাম, পাহাড়গুলা আসলে পাহাড় নয়, জলাধারও কেবল জলাধার নয়।
এখন আমি চূড়ান্ত জ্ঞান লাভ করেছি, বোধপ্রাপ্ত হয়েছি, এখন আমি বলি, পাহাড়গুলা পাহাড়, জলাধার হইল জলাধার।
[মাসাও আবে, জেন এন্ড ওয়েস্টার্ন থট]
ইংরাজি অনুবাদে "ওয়াটার্স" আছে শব্দটা। এই কনটেক্সটে বডি অব ওয়াটার হবে। অর্থাৎ সমুদ্র, নদী ইত্যাদি। উল্লিখিত বঙ্গানুবাদে সমুদ্র দিলেও হইত, বা পানি দিলে। কিন্তু পানি দিলে হয়ত বডি অব ওয়াটারের বিষয়টা ধরা যাইত না, তাই জলাধার দেয়া।
শেইজেন ইশিনের এই মহান শিক্ষা বুঝাটা দরকারি।
যখন একজন না জানা অবস্থায় দেখেন, তখন তার দেখাটা হয় নিজের পূর্ব ধারণা, চিন্তা ও বিশ্বাস নিয়ে। যেমন আপনে একটা পাহাড় দেখলেন, যেমন নিচের পাহাড়।
যখন আপনি পাহাড় দেখলেন, নিজের ধারণা যে আছে পাহাড় নিয়া, পাহাড় বিষয়ে যেসব লেখা পড়ছেন, ছবি দেখছেন, ফিলিম দেখছেন, গল্প শুনছেন, সব মিলিয়ে যে ধারণা ও বিশ্বাস তৈরি হইছে, সেসব সহকারেই এই পাহাড়টারে দেখলেন।
একইভাবে সমুদ্র দেখলেও।
শেইজেন ইশিনও এইভাবে দেখেছিলেন।
তার কাছে সমুদ্র ও পাহাড়ের আর কোন অর্থ নাই। স্বাভাবিক দম্ভ সহকারেই তার বলা, পাহাড় পাহাড়ই, সমুদ্র সমুদ্রই। যেমন সব সাধারণ লোকে বলবেন।
জেন শিক্ষা পাবার পরে, তিনি বুঝলেন সকল কিছুই এক। পাহাড় তো পাহাড় না, সমুদ্র সমুদ্র না, সবই এক রূপের নানা প্রকাশ।
এইখানে আসার পরে আগের পাহাড় ও সমুদ্র সম্পর্কে সাধারণ ধারণার বিলোপ হইল। তিনি বুঝলেন, সমুদ্রের মধ্যে কোন এক অংশ ধরে বলা যাবে না এটা সমুদ্র, কারণ আসলে সমুদ্র বলতে কিছু হয় না। বিশাল জলাধার, জলজ প্রাণী উদ্ভিদ কতো কিছু মিলাইয়া যে অস্তিত্ব, তার এক নাম দেয়া হইছে সমুদ্র। একই কথা পাহাড়ের ক্ষেত্রেও। গাছ গাছালি, পোকা মাকড়, কতো কিছুর সম্মিলনে এই যে অস্তিত্ব, যেটারে বলা হইতেছে পাহাড়, আসলে এই পাহাড় বলতে তো আলাদা কিছু নাই।
এরপরে, অনেক সাধনার পরে, এনলাইটনমেন্ট বা বোধ লাভ যখন হলো, শেইজেন ইশিন বললেন, পাহাড় পাহাড়ই, সমুদ্র সমুদ্রই।
এইবার কিন্তু তিনি প্রথমবারের মত অজ্ঞতা থেকে, সাধারণ ভাবে বলেন নাই।
এবার তিনি পাহাড় ও সমুদ্র সম্পর্কে তার পূর্ব ধারণাগুলি থেকে মুক্ত হইছেন। এগুলিরে দেখার যে চিরাচরিত অভ্যাস ছিল, সেগুলি থেকে মুক্ত হইছেন।
এবং দ্বিতীয় ধাপের, এগুলিরে সবের সাথে এক করে দেখা, অর্থাৎ না দেখার স্তর অতিক্রম করে গেছেন।
এখন তিনি পাহাড়রে কেবল পাহাড় হিশাবেই দেখতেছেন, সমুদ্ররে সমুদ্র হিশাবে।
মানে জিনিশটা যেমন আছে তেমন। জিনিশটার সত্যিকারের প্রকৃতিরে উপলব্ধি করতে পারা, অনুভব করা।
এই স্তরে যাওয়াটাই বোধলাভ। নিজেরে সব কিছু থেকে বিযুক্ত করে জিনিশটা যেমন আছে, ঠিক তেমনই দেখতে পারা। কঠিন সাধনার পরে এই স্তরে যাওয়া সম্ভব। যিনি যাইতে পারবেন তিনিই সাধু।
পাহাড় এবং সমুদ্রের উদাহরণ হইলেও, অন্যান্য জিনিশ নিয়া ভাবেন। প্রায় সব কিছুই মানুষ নিজের পূর্ব ধারণা, চিন্তার নিরিখে দেখে ও বিচার করে। ফলে, সে আসলে ওই বস্তু দেখে না।
যে লেখা পড়তেছে, ওই লেখাটা পড়তেছে না, বরং, আরো অনেক কিছু নিয়া পড়তেছে। পূর্ব ধারণা, বিশ্বাস, তথ্য ইত্যাদি। পণ্য দেখতেছে যখন, তখন তার ব্র্যান্ড সহ দেখতেছে।
ভাষা জিনিষটাই সমস্যার তৈরি করে। যেমন পাহাড় বা সমুদ্র শব্দ, এইগুলা কিছু জিনিশ বুঝায়, যা আমাদের মস্তিষ্কে তথ্যাকারে জমা আছে। সেইসব তথ্যের হিশাবেই আমরা যা দেখতেছি সামনে, প্রাকৃতিক এক সুউচ্চ শৃঙ্গ বা বিরাট জলাধার, এইগুলারে বিচার করতেছি।
যে বা যা যেমন আছে, তেমন দেখতে পারাই সাধনার লক্ষ্য ও পথ।