খ্যাতির বিড়ম্বনা শব্দটার লগে আপনে হয়ত পরিচিত আছেন। স্কুলের পাঠ্যবইতে একসময় এই শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই কৌতুক নাটিকা ছিলো। এর গল্পটা এইরকম, একজন উকিলের কাছে দানের চাঁদা চাইতে আসেন এক লোক। উকিল তারে চাঁদা দেন না, তাড়িয়ে দেন। ওই লোক গিয়ে পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেয়, উকিল সাপ তাদের অনুষ্ঠানে ৫ হাজার টাকা দিছে। উকিল এতে প্রথমে খুশি হন। কিন্তু পরে দেখতে পারেন এর ডাউন সাইড। দলে দলে লোক আসতে থাকে তার কাছে চাঁদার জন্য। এক পর্যায়ে তিনি মামার বাড়ি পালাতে বাধ্য হন।
ঠাকুর খ্যাতির বিড়ম্বনার একটা ফানি উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু খ্যাতির এই ফানি বিড়ম্বনার বাইরে এক ভয়ানক সাইড আছে।
সাম্প্রতিক পরীমনি ও নায়ক শরীফুল রাজের ইস্যু নিয়া শুরু করি, যেহেতু তাদের বিষয়ে আরেকটা এনালাইসিস করেছিলাম।
রাজের ফেসবুক পেইজ থেকে কিছু ভিডিও লিক হইল, তার বন্ধু অভিনেত্রী সুনেরাহ, অভিনেত্রী তিশা ইত্যাদিদের সাথে।
ধারণা করা হইতে থাকলো রাজের স্ত্রী পরীমনি এই কাজ করছে। তাদের মধ্যে যেহেতু একটা দ্বন্দ্বমুখর সম্পর্ক বিরাজমান।
এইগুলাতে আমার লেখার মত আগ্রহ তৈরি হয় নাই, কিন্তু যখন দেখলাম অভিনেতা ও উপস্থাপক জয় একটা ভিডিও ছাড়ছেন, যেখানে তিনি বলতেছেন পরীমনিরে বয়কট করতে হবে, তখনই আমার পুরা ঘটনারে ইন্টারেস্টিং লাগতে শুরু করলো। এবং পরে যখন দেখলাম রাজও নাজিম জয়রে সমর্থন দিতেছেন, তখন জিনিশটা আরও ক্লিয়ার হইয়া উঠলো আমার কাছে।
আপনে কি বলতে পারেন, কেন শাহরিয়ার জয় এইরকম এক কঠিন অবস্থান নিয়ে ফেললেন অভিনেত্রী পরীমনির বিরুদ্ধে? যেখানে এইটা কে লিক করছে তা এখনো প্রমাণিতই না।
এই প্রশ্নটারে এনালাইজ করেই খ্যাতি জিনিশটারে বুঝার ট্রাই করব।
আপনে যখন বিখ্যাত হয়ে যাবেন, তখন আপনার গোপনীয়তা হয়ে যাবে অন্যদের টাকা উপার্জনের, বা অন্য কোন ক্ষমতা লাভের উপায়।
দেখবেন, মানুষ ফেমাস হইয়া গেলে কেবল ফেমাসদের সাথেই ঘুরে ফিরে। সাধারণের লগে চলে না।
ফেমাসদের বন্ধুরা হয় ফেমাসেরা। তারা একসাথে আড্ডা দেয়, পার্টি করে, ইত্যাদি।
সাধারণ মানুষ ভাবে যে এরা ফেমাস হইয়া হয়ত ভাব মারতেছে।
কিন্তু, এইটা কেন হয়? এর কোন বাস্তবিক কারণ আছে কী?
আছে, ফেমাসেরা জানে তাদের গোপনীয়তা অন্য সাধারণেরা বিক্রি করবে। তাই তারা সাবলীল ভাবে সাধারণের লগে মিশতে পারে না। তাদের মিশতে হয় অন্য ফেমাসদের লগে। কারণ ফেমাসেরা সবাই এইটা জানে ও মানে যে, তাদের সিক্রেসি রক্ষা করতে হবে। তারা উভয়েই পরস্পরের গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে।
অর্থাৎ ফেমাসদের দুনিয়ায় এইটা হইল একটা রুল, গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশের অভিনেতা অভিনেত্রীদের যে সমাজ আছে, ধরে নেন একটা কাল্পনিক সমাজ আছে, ওইখানেও এই রুলটা তারা মানে। একজনের গোপন জিনিশ আরেকজন প্রকাশ করবে না।
এবং হঠাত হঠাত পরীমনির মত ঘাউরা দুয়েকটা চলে আসে। এরা এই সিক্রেসির নিয়মরে মানে না নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের রাগ ক্ষোভ ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য, বা মানসিক অবস্থার কারণে।
আর তখন, জয়ের মত যারা নিজেদের এই অভিনেতা অভিনেত্রী সমাজের অভিভাবক জ্ঞান করে, তারা বুঝতে পারে আঘাতটা খালি রাজের উপরে না, আঘাতটা তাদের টোটাল ফেমাস সমাজের একটা প্রধান রুলের উপরে।
তাই সে একটা দায়িত্ববোধের তাড়না অনুভব করে যে, ভিডিও করে বলতে হবে পরীমনিরে বয়কট করতে হবে।
এইখানে আয়রনি হচ্ছে, জয় সেন্স অব হিউমার ইত্যাদি করে নতুন ভাবে জনপ্রিয় হইছেন এই ডিজিটাল সময়ে, এইখানে তার পূঁজি ছিল ফেমাসদের সিক্রেট বাইর কইরা আনা।
রাইট বা রং এর হিশাব না, একটু খিয়াল কইরা পড়েন, ভালো বা খারাপের হিশাব নিলে, যেকোন একজনের খুব পার্সোনাল ভিডিও/ছবি তার অনুমতি ছাড়া প্রকাশ অনৈতিক, অন্যায় এবং অপরাধ। যে করছে তার বিচার হোক।
আমি ভাবতেছি এই ফেমাসদের বাস্তবতা নিয়া।
ফেমাসেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের সাথে গভীর কোন সম্পর্কে যাইতে পারে না। এর কারণ তারা তাদের দূর্বলতা, গোপন গল্প ইত্যাদি ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সাথে শেয়ার করতে পারে না।
ফেমাসদের সাথেও পারে না, কিছু লাকি ব্যক্তিক্রম ছাড়া বন্ধুদের সাথেও পারে না। কারণ তাদের ভয় থাকে এইগুলা বের হইয়া যাইতে পারে। মিমেটিক ডেজায়ারের কারণে ফেমাসদের সাধারণত বন্ধুও থাকে না।
যে ভিডিওগুলা লিক হইছে রাজ সুনেরাহ এনাদের, পরাণের পরের ফেমাস রাজ হইল এই ভিডিওই করতো না হয়ত।
আবার, এর পর রাজ সুনেরাহ তিশা বা আরও অভিনেতা অভিনেত্রী যারা আছে, তারা তাদের ফেমাস বন্ধুদের লগেও এমন সিক্রেট ভিডিও বন্দী হইতে দিবে না, এমনকি সিক্রেট শেয়ার করতে গেলেও সাবধান থাকবে।
মানুষে মানুষে গভীর সম্পর্ক তখনই হয় যখন তারা গোপন গল্প পরস্পর শেয়ার করে, এর মধ্যে মিল খুঁজে পায়, গল্পগুলার সূতায় নিজেদের একসাথে বান্ধে, ও নিজেদের দূর্বলতা পরস্পরের সাথে শেয়ার করে। এইগুলাই সম্পর্করে গভীর বানায়।
কিন্তু ফেমাসদের সদা সতর্ক থাকতে হয়। ইভেন প্রেমিক প্রেমিকার বা বউয়ের লগেও তারা সিক্রেট শেয়ার করতে ভয় পায়। কারণ সম্পর্ক খারাপ হইলে অন্য পক্ষ এইগুলারে ব্যবহার করবে। জানাজানি হবে, আপনারা তো জনি ডেপ আর এম্বার হার্ডের বিচার দেখছিলেন আগ্রহ নিয়া, এবং জানছিলেন যে ঝগড়ার এক পর্যায়ে এম্বার হার্ড বিছানায় হেগে দিছিলো।
বা বিচ্ছেদের পর জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খানের সাবেক স্ত্রী যে বই লেখছিলেন, তাতে জানছিলেন যে সলিমুল্লাহ খান তার সৎ পোলার লগে বাজে আচরণ করতেন, ইত্যাদি।
জনপ্রিয়তারে দুইটা ধরণে ভাগ করতে পারেন বুঝার সুবিধার্থে। লেখকদের যে জনপ্রিয়তা, আর অভিনেতা অভিনেত্রীদের তথা পারফর্মিং আর্টিস্টদের যে জনপ্রিয়তা, তা একরকম হয় না সাধারণত। লেখকেরা জনপ্রিয় হন নীশ ভিত্তিক। একটা নির্দিষ্ট টপিকে আগ্রহী লোকেরাই তার ফ্যান হন, তারে চিনেন ইত্যাদি। কিন্তু পারফর্মিং আর্টিস্টদের, বিশেষত যাদের টিভি সিনেমায় দেখা যায়, তাদের নানা স্তরের বেশী লোকে চিনেন।
কিন্তু দুই ধরণের জনপ্রিয়তাতেই ফ্যানের একটা চাপ থাকে। ফ্যানেরা কী চায়। তথাকথিত ফ্যানবেইজ যত বেশী হবে, তত চাপ বেশী হয়।
ফ্যানদের সন্তুষ্ট করতেই জনপ্রিয় ব্যক্তি তার কাজকর্ম করে যান।
এক পর্যায়ে এইটাই তার চাকরী হয়। তিনি কিছু কথা পাবলিকলি বলতে পারবেন না, কিছু ভুল কখনোই করতে পারবেন না।
কারণ ফেমাস ব্যক্তির ফ্যান যত থাকে, মিমেটিক কারণে তার হেটার থাকে বেশী। ধরা যাক, বাংলাদেশের সব স্তরের বিচারে সবচাইতে বিখ্যাত ব্যক্তি এখন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। আমরা দেখি তার অনেক ফ্যান। কিন্তু সে একটা গর্হিত অপরাধ করে ফেলুক। ইভেন গর্হিত বাদ দেন, গ্রে এরিয়াতে থাকা কোন কাজ করে ফেলুক। তখন দেখবেন তার চিহ্নিত হেটারদের সাথে সাথে নীরব অনেক হেটার গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে।
মিমেটিক কারণে মানুষ আপনার পতন চায়, আপনার ধ্বংস চায়, আপনার সুখের বিনাশ চায়। ফেমাসদের ক্ষেত্রে ওইটা কয়েকগুণ বেশী হয়।
দৃষ্টি দিয়া ভস্ম করে দেয়ার একটা ব্যাপার আছে মিথোলজিতে। এটা যদি সত্যি সত্যি হইত, তাহলে অনেক ফেমাস ব্যক্তিই মানুষের হিংসার দৃষ্টির আগুনে ছাই হইয়া যাইত, আপনি দেখতেন ওই জায়গাতে কেবল ধোঁয়া উড়তেছে, আর কালো কালো ছাই।
হেটারদের দিক ছাড়াও ফ্যানদের দিক থেকে সমস্যা থাকে।
ফ্যানরা ফেমাস ব্যক্তিরে অউন করে এমন মনে করতে থাকে। পরীমনি ও রাজ বিষয়ে আগের লেখায় বলছিলাম, কারো পূজার বস্তু হওয়া ভয়ংকর। একই কথা এইখানেই প্রযোজ্য, এই বিশাল ফ্যানদের পূজার বস্তু হইয়া গেলে তাদের অধীনই হইত হয়। এইখানে দ্বন্দ্বটা এইভাবে দেখতে পারেন, পরীমনি তার ‘লাভ/তাদের এগ্রেশনরে লাভের নেগেটিভ প্রকাশ ধইরা নিয়া' দিয়া রাজরে দখল করতে চাইতেছে, কারণ সে সাবকনশাসলি ফিল করে রাজ ফেমাস হইয়া গেলে ভক্তদের অধীন হইয়া যাবে।
ফলে এইসব নানা ঘটনার মাধ্যমে সে চাপ তৈরি করতে চায়।
ভক্ত ও ফেমাসের সম্পর্কের ব্যাপারটা নিয়া ভাবলেই আমার গুরু শাহ আব্দুল করিমের গানটার কথা মনে হয়, তিনি এক স্পিরিচুয়াল মহাসত্য প্রকাশ করছিলেন, “ভক্তের অধীন হও চিরদিন, থাকো ভক্তের অন্তরে" বইলা। [একটু অন্য প্রসঙ্গ হইলেও এখানে বলে রাখি, এই গানে আব্দুল করিম বলতেছেন, কোন সাগরে খেলতেছ লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে। এইখানে সিলেটী ভাষায় লাই একটা খেলার নাম, যেইখানে পুকুরে অন্যরা ডুব দিয়া সাঁতরাইতে থাকে, এবং আরেকজনের কাজ হয় তাদের ছোঁয়া। করিম আল্লাহরে বলতেছেন, তুমি কোন সাগরে আমার সাথে লাই খেলতেছ আমি এইটাই ভাবতেছি।]
দেখবেন যে প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়, সেলিব্রেটিদের ব্যক্তিগত কিছু থাকতে পারে না। এই কথাটার আরেকটা উহ্য দিক হচ্ছে, যার ব্যক্তিগত কিছু নাই সে ব্যক্তি হিশাবে বিরাজই করে না, সে হয় দাস।
আর যেইসব ফ্যান ফেমাস ব্যক্তিটার মত হইতে চায়, তারা এক পর্যায়ে ওই ব্যক্তিটারে হিংসা করতে থাকে, এবং সবচাইতে বড় হেটারে পরিণত হয়।
তাহলে কি ব্যক্তি ফেমাস হবে না?
আমি কাউরে কিছু হওয়া বা না হওয়ার কথা বলতেছি না, তা বলার এখতিয়ার নাই। একটা দিক দেখাইতেছি কেবল।
দার্শনিক বড় ভাই হেনরি ডেভিড থরো যেই কথাটা বলছিলেন, তা মনে রাখার ট্রাই করি। তিনি বলছিলেন, কোন কিছুর দাম হইল তুমি এর জন্য তোমার লাইফের যে অংশ দিতেছ।
সিম্পল টার্মে, আপনে ভাবতেছেন এই লেখা অল্প টাকায় বা বিনামূল্যে পড়ে ফেলতেছেন। কিন্তু আসলে এইটা সত্য না। সত্য হইল এর জন্য আপনি আপনার লাইফের একটা সময় দিতেছেন, যেই সময় অনেক মূল্যবান।
এইখানে একনোমিক্সের অপরচুনিটি কস্টের কথা আসে।
আপনি মুভি দেখতেছেন এক ঘণ্টায়, এই ক্ষেত্রে আপনার এটেনশন ইত্যাদি এক প্রাইস। আরেক প্রাইস হইল, যা এই এক ঘণ্টায় করতে পারতেন।
বা ১০০ টাকা দিয়া সিগারেট খাইতেছেন মানে, এই ১০০ টাকা দিয়া বই কিনতে পারতেছেন না, ইত্যাদি।
এবং আরও সুন্দরভাবে আমি ফাউস্টিয়ান বার্গেইন দিয়া বুঝি। ডক্টর ফস্টাসরে মেফিস্টোফিলিস, শয়তানের বাদশা বলছিলো, দুনিয়ার সব জ্ঞান দিব তোমারে, তুমি দিবা তোমার আত্মা।
ফস্টাস রাজী হয়।
এইরকমই একটা বার্গেইন থাকে অলওয়েজ।
তুমি কী পাইতেছ, আর কী দিতেছ, এই দেনা পাওনার দাঁড়িপাল্লার হিশাব তোমারেই করতে হবে।
ইনভেস্টিং এর দিক থেকে ওয়ারেন বাফেট যেই কথাটা বলছিলেন। লাইফের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তোমার যা দরকার নাই, তার জন্য যদি তোমার যা আছে তারে তুমি রিস্কে ফালাইয়া দাও, এইটা পাগলামি।