চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের গরু নিয়ে ভাইরাল ভিডিওটি ফালতু। তিনি যে এঙ্গেলে সমালোচনা করতে চাইছেন কাও হাগ ডে'রে তা হাস্যকরও হয় নাই, লজিক্যালও হয় নাই। এবং ফান্ডামেন্টালি তিনি "পবিত্র গরুর" পবিত্রতার যে ধর্মীয় কনসেপ্ট তা বুঝতে পারেন নাই, বা ইচ্ছা করেই যান নাই ওইদিকে, কারণ তা হলে এইভাবে হালকা হাস্যরস করা যেত না।
চন্দ্রিল বলতে চাইছেন, হাগ করা নিয়া গরু কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, মানুষের আচরণ গরুর সাথে করলে। সেইটা বলতে গিয়া আবার তিনি গরু মনে করবে তার দুধ নিয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি বলে মানুষের বৈশিষ্ট্য, চিন্তা, বুদ্ধি গরুর উপর চাপাইতে চাইছেন। যেন গরু যাবতীয় সব গরু নির্যাতনের ইতিহাস মাথায় রেখে বসে আছে।
গল্পকার ওয়াহেদ সুজন যে প্রসঙ্গটি এনেছেন, হাস্যকর মশকরা করার মত না বিষয়টা, এইটা এক ভ্যালিড পয়েন্ট। কারণ ঐতিহাসিক ভাবে গরু বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানের দ্বন্দ্বটা আছে এখানে।
সিলেটে শাহজালাল (র) আগমনের যে গল্প প্রচলিত, সেখানে আছে একজন মুসলমান ব্যক্তি গরু কোরবানি করে হিন্দু রাজার রোষানলে পড়েন, রাজা তার হাত কেটে দেন। পরে শাহজালাল এটাক করেন সিলেট।
রবীন্দ্রনাথের জমিদারীর এক জায়গায় ছিল মুসলিম মেজরিটি। কিন্তু তারা গরু কোরবানি দিতে গেলে হিন্দু প্রজারা অভিযোগ নিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ অভিযোগ শুনলেন। মুসলিম প্রজাদের ডেকে নিয়ে বললেন, "একটু ভিতর বাড়িতে রেখে-ঢেকে এই গরু জবাই করো।" আহমদ শরীফ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন রেখে ঢেকে করবে? হয়ার দ্য মুসলিমস আর মেজরিটি ইন দ্য ভিলেজেস?
১৮৮৯ সালে গো-জীবন প্রবন্ধে মীর মশরারফ হোসেন কৃষি নির্ভর দেশ, এবং হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদির যুক্তিতে গরু কোরবানি না দিয়া অন্য কিছু কোরবানি দেয়ার পরামর্শ দেন, যেহেতু গরু দিতেই হবে এমন কোন ধর্মীয় বিধান নাই। তার এই প্রবন্ধের পরে মুসলমান নেতৃস্থানীয়রা এর নিন্দা করেন, ধর্মসভা ডেকে তাকে কাফের ঘোষণা দেয়া হয়, এবং এক পর্যায়ে লেখক প্রবন্ধটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
কালচারাল ম্যাটেরিয়ালিজমের মারভিন হ্যারিস দেখিয়েছিলেন, ভারতে গরু হত্যা নিষিদ্ধ হওয়া আগে থেকে ছিলো না, পরবর্তীকালে হয়েছে, এবং এর কারণ কৃষিনির্ভরতা।
ইন্ডিয়া এখন প্রচুর পরিমাণ গরুর মাংস উৎপন্ন ও রপ্তানি করে থাকে। কিন্তু মুসলিমদের বিরুদ্ধে গরুকে কেন্দ্র করে হত্যা, নির্যাতনের ঘটনা, এবং ত্রাশ তৈরি করে যাচ্ছে বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদ। ভ্যালেন্টাইনস ডে তে কাও হাগ ডে সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
এখানে গরু তো কেবল প্রাণী গরু নয়, যেমন চন্দ্রিল ধরে নিয়া মশকরা করেছেন, বরং গরু এখানে এক বৃহত্তর আইডোলজির অংশ, যেইটার ভিজুয়াল রূপ দিতে ব্রিটিশ আমলে কাজ করে গেছেন বিখ্যাত আর্টিস্ট রাজা রবি ভর্মারা। তারা গরুর ভেতরে দেব দেবী, এবং হিন্দু-শিখ সম্পর্ক উন্নয়ন কল্পে শিখ গুরুদেরও এঁকেছিলেন, যেই ছবিগুলি ক্যালেন্ডার আর্টের মাধ্যমে বহুল প্রচারিত হয়।
গরুর উপর আরোপিত এই "পবিত্রতা" গরুকে কেবল প্রাণী রাখে না আর।
মানুষের এই ধরণের বিশ্বাস, এবং সেই বিশ্বাসের সাপেক্ষে তাদের জান প্রাণ দিয়ে কাজ করার সংকল্পের আধ্যাত্মিক বাস্তবতা যে আছে, এটারে পাশ কাটাইয়া গেলে, সমাজ ও মানুষরে বুঝা সম্ভব নয়। এবং যে সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছে তা সমাধানের দিকে যাওয়াও সম্ভব নয়।
সাইকোএনালিস্ট, ও দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক দার্শনিক পিটার সিংগারের সমালোচনায় একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন, যার একাংশের উল্লেখ এখানে করতে হচ্ছে।