একটা হাইপোথিসিস আছে, প্রাণী হিশাবে মানুষের ব্রেইন কীভাবে ডেভলাপ করল এই বিষয়ে। সাধারণ ধারনা, প্রতিকূল পরিস্থিতি, অন্যান্য প্রাণীদের আক্রমণ ইত্যাদির মাঝে টিকে থাকতে মানুষের ব্রেইন উন্নত হয়েছে। কিন্তু এই হাইপোথিসিস বলে, না, অন্য মানুষদের সাথে সামাজিক বাস্তবতায় প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়া টিকে থাকতেই মানুষের ব্রেইন ডেভলাপ করেছে।
এইটারে আমার বেশি যৌক্তিক মনে হয়।
মানুষদের গেইম দিনশেষে মানুষদেরই লগে। ধান্দাবাজি, বাটপারি, সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন, ভালো খারাপ মানুষ চিনতে পারা, মানুষের লগে একসাথে কাজ করতে পারা, ইত্যাদি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একজন মানুষের জন্য।
এর জন্য নিজেরে জানা দরকারী। নিজেরে জানতে, বুঝতে বিগ ফাইভ পার্সোনালিটি টেস্ট খুব ভালো। এই টেস্ট এখান থেকে আপনি ফ্রিতে করতে পারবেন।
এই টেস্ট পাঁচটা ভাগে আনুমানিক ভাবে আপনারে মাপে; সেই পাঁচটা ভাগ হইলঃ
Openness to experience , Conscientiousness , Extraversion , Agreeableness and Neuroticism
আপনি যদি এখানে টেস্ট করে দেখতে পান, আপনি নিউরটিসিজমে খুব হাই, তখন বুঝতে পারবেন আপনার নেগেটিভ ইমোশন বেশি। তারা ভাগ ভাগ করে দেখায় কী কী ইমোশন। এই বুঝাটা আপনার নিজেরে বুঝতে সাহায্য করতে পারে, কোন দিকে ইম্প্রুভ করা দরকার বা কী ধরণের পেশা নির্বাচন করা দরকার, ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
যাই হোক, নিজেরে চেনার এক পরীক্ষা গেল। এখন অন্যরে চেনা বিষয়ে, বা বিশেষত সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশনের কিছু বিষয় চেনা বিষয়ে আলাপ করা যাক।
সমাজে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে এক ভিত্তিমূলক কনসেপ্ট দেন ১৯৫৮ সালে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী জর্জ হোম্যান সাহেব, নাম সোশ্যাল এক্সচেঞ্জ থিওরি। পরে পিটার মাইকেল ব্লাউ সহ আরও অনেকে এটারে বিস্তারিত করেন নানা দিকে। নানাদিকে বিস্তারিত হওয়ায় এটা থিওরি না, বরং একটা বড় কনসেপ্ট। এইটা বেসিক্যালি বলে, সমাজে সব ধরনের সম্পর্ক, রোমান্টিক, প্রফেশনা বা এনি সম্পর্ক মানুষ করে নিজের একটা লাভ-ক্ষতির বিচার করে। সে যদি মনে করে এই সম্পর্কে তার লাভ আছে, তখনই সে সেই সম্পর্ক চালিয়ে যায়।
এভলুশনারি সাইনিস্ট ডেভিড বাস বলেন যে, মানুষ তার চিন্তায় একটা হিশাবের খাতা রাখে। এটারে নাম দিতে পারেন মেন্টাল একাউন্টিং। সেখানে হিশাব থাকে, এই সম্পর্কে সে কত দিছে, এবং কী পাইছে।
এই হিশাবে যতদিন সে লাভে থাকবে, ব্রেক ইভেনে থাকবে, বা কম পাইলেও দেয়ার অনুপাতে সীমার ভেতরে থাকবে, ততদিন সে সম্পর্কটারে গুড মনে করবে।
এইটা একটা বড় বিষয়। আপাতত এই বিষয় এইখানে শেষ করি, কারণ আমাদের আজকের বিষয় অন্য। এটা উল্লেখ করতে হইল, কিছু বেসিক ক্লিয়ার করতে, যাতে যখন মুল বিষয়টা নিয়ে বলব সেটা স্পষ্ট হয়।
সোশ্যাল এক্সচেঞ্জ বা সামাজিক বিনিময় সম্পর্কের ভিত্তিতে থাকার কারণে মানুষের কোর বা একেবারে মৌলিক যে কিছু সাইকোলজিক্যাল প্রবণতা আছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা রেসিপ্রোসিটি। সাইকোলজিস্ট রবার্ট চিয়ালদিনি তার ইনফ্লুয়েন্স বইয়ে এর গুরুত্ব বুঝান, ও বেশি মানুষের কাছে নিয়া যান।
এইটা বলে, মানুষের সাথে আপনি ভালো আচরণ করলে, সেও আপনার সাথে ভালো আচরণ করবে। খারাপ করলে সেও খারাপ করবে।
এক খুবই মৌলিক প্রবণতা।
এখন, এই মূল জিনিশটারে যদি গেইম করা যায়, তাহলে কেমন হয়?
যেমন, এখন বুঝাইল, সে আপনার জন্য অনেক করছে, অনেক ভ্যালু দিছে আপনারে, এবং আপনি বিশ্বাসও করে ফেললেন, তখন আপনি কী করবেন?
তারে পালটা ভ্যালু দিবার ট্রাই করবেন।
ম্যানিপুলেশনের মূল এইটাই। ম্যানিপুলেটর সোশ্যাল এক্সচেইঞ্জ ফ্রেইমওয়ার্করে ব্যবহার করে রেসিপ্রোসিটি প্রবণতারে গেইম করে। সে কম ভ্যালু এড করে দেখায় বেশি ভ্যালু এড করছে, এবং আপনার কাছ থেকে ভ্যালু নিয়ে যায়।
এইটা সে কিভাবে করতে পারে?
অনেক মানুষ দেখবেন, চান্স পাইলেই আপনারে শুনাইয়া দিবে আপনার জন্য সে কী কী করছে। এইটা বার বার করবে। যা করছে তা নানাভাবে ফুলাইয়া ফাঁপাইয়া, নানা এঙ্গেলে বলবে।
এক ব্যক্তি আমেরিকায় আছেন ত্রিশ বছর ধরে। নিজের যোগ্যতায় তিনি অনেক কিছু করছেন। কিন্তু, তিনি আমেরিকায় আসছিলেন বিয়া করে। তার বউ তারে নিয়মিত শুনাইয়া যান, তোমার যা হইছে, সব আমার জন্য, আমার ফ্যামিলির জন্য।
তার বউয়ের এই কাজ এইখানে, মানসিক ভাবে ঋণী এবং দূর্বল করে দেয়া। তিনি এটা কেন করতেছেন? এই সম্পর্ক থেকে নিজে বেশি ভ্যালু নেবার জন্য।
ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল সাম্প্রতিক যে লাইভ করেছেন, এইখানে দেখবেন তিনি তার জেলে থাকা, তার স্ট্রাগল ইত্যাদিরে কীভাবে বড় করে দেখাইছেন, এবং কীভাবে পুরা বিষয়টারে ফ্রেইম করেছেন। সাধারণ চোখে দেখলে আপনার মনে হবে, তিনি সাধারণ মধ্যবিত্ত গ্রাহকের ভালোর জন্য কাজ কড়তে গিয়া আজ ভুক্তভোগী। কিন্তু, আসলে তিনি বা তার কোম্পানি করাপশন বা ভুল স্ট্র্যাটেজি-মিসম্যানেজমেন্টের কারণে শত শত লোকের টাকা দিতে পারে নাই, স্পষ্ট প্রতারণা করছে।
তার উদ্দেশ্য, যাতে তার গ্রাহকেরা তার ভুলগুলা (যেগুলারে তিনি স্পষ্টভাবে বলতেছেন, তিনি মনে করেন ভুল না) ভুলে যান, এবং আবার বিশ্বাস করে তার কাছ থেকে কিনেন। অর্থাৎ, তিনি এই সম্পর্ক থেকে তার ভ্যালুটা নিয়ে নিতে চান।
এইরকম যারা, জিনিশটা গেইম করে, এবং বেশি ভ্যালু নিতে চায় সাইকোলজিক্যাল গেইম খেলে তাদের প্রতি আপনার স্ট্র্যাটেজি কী হবে?
আপনে উলটা একই গেইম খেলতে পারেন তার সাথে।
যেমন, একটা উদাহরণ দেই, ধরা যাক আপনি এক কোম্পানিতে কাজ করেন। ঈদ উপলক্ষ্যে আপনি ঠিক করলেন সব এমপ্লয়ীদের শুভেচ্ছা প্যাকেজ পাঠাবেন।
আপনারসিইও এগ্রি হইলেন। এমন কাজ তারা আগে করেন নাই।
আপনি সব কাজ করলেন। যা যা দিবেন তা সিইওরে আগে দেখাইলেন। তিনি টাইমমত এগুলা নিয়া মতামত দিলেন না।
শেষে কোনোমতে ঈদের কয়দিন আগে সব ঠিক হইল।
তখন দেখা গেল, একটা প্রডাক্টে লোগো ঠিকমত আসে নাই। ব্যাকগ্রাউন্ড কালারের সাথে লোগোর কালার মিলে কনট্র্যাস্টে ঝামেলা হইছে।
এইবার কিন্তু সিইও আপনারে ধরলেন, আরে, আপনে এইটা কী করছেন। আমাদের এত নামী কোম্পানি। ভুল লোগো গেলে বেইজ্জ্বতি হবে আমাদের। সামাজিক মাধ্যমে মানুষ পোস্ট করবে। এইরকম আগে হইছিল একবার।
তিনি প্রায় আপনারে ঘণ্টার মত লেকচার দিলেন।
এখন, আপনে প্রায় গরুচোদা হইয়া গেলেন! যে সিইও আগে টাইম বের করতে পারল না গিফট এপ্রুভালের সময়, সে এখন বার বার লেকচার দিবার টাইম পায়।
এক পর্যায়ে সিইও বলল, আচ্ছা যাই হোক, এইবারের মত আপনার এই কাজটা মেনে নিচ্ছে। বিশ্বাস করেন, কেবল আপনি বলেই মানতেছি। আপনি বুঝতেছেন না আমি কত বড় রিস্ক নিচ্ছি। কিন্তু তাও আপনার জন্য নিচ্ছি, প্রডাক্ট বাদ দিবার দরকার নাই, দিয়া দেন।
এইখানে কী করল সে?
কাজ করলেন আপনি, কিন্তু সে নিজেরে গিভারের পজিশনে নিয়া গেল। যেন এই এক্সচেইঞ্জে সে ভ্যালু দিচ্ছে, এবং আপনারে ঋণী করতেছে, আপনার এখন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
শুধু আপনার জন্য করতেছি, এটা বলে ঋণ আরও বাড়াইল।
আপনি এইখানে পড়ছেন একটা ম্যানিপুলেটরের পাল্লায়। সে বুঝে বা না বুঝে এই জিনিশ আপনার সাথে করতেছে।
তাছাড়া, কোম্পানি সর্বদা এটা করবে এমপ্লয়ীর সাথে। কারণ কম্পানি-এমপ্লয়ী এই সামাজিক সম্পর্কে কোম্পানি চাইবে সব সময় নিজেরে বেশী ভ্যালু দেয়া এনটিটি প্রমাণ করতে। এর জন্য তার স্ট্র্যাটেজি, সুযোগ পাইলে এমপ্লয়ীর অবদানরে খাটো করে দেখানো।
তাহলে, আপনার কী করা উচিত?
আপনি সব সময়, কাজটা করার ক্ষেত্রে আপনার যেই যেই পরিশ্রম হইতেছে, স্ট্রাগল হইতেছে তা এই সিইওরে জানাইয়া রাখা উচিত।
এইটা এক ধরণের উলটা স্ট্র্যাটেজি, তার ম্যানিপুলেশন থেকে বাঁচতে।
এইটা একদিক দিয়া খারাপ। কাজ তো করার কথা, কীভাবে কি করলেন, সব জানাইতে গেলে তো বেহুদা টাইম নষ্ট। আবার, ম্যানেজার বা সিইওর জন্যও খারাপ, কারণ, একজন ভালো ম্যানেজার এগুলা শুনতে চাইবে না। কারণ সে আপনারে রাখছেই এই কাজগুলা করার জন্য। কিন্তু, যখন সে ম্যানিপুলেটর, আপনার ক্ষতি করতেছে, তখন তার গেইম তার সাথে খেলতেই হবে নিজেরে বাঁচাইতে। অথবা, তার থেকে দূরে সরে যাইতে হবে।
যখন আপনি তারে এগুলা জানাইয়া আগেই ঋণী করে রাখার চেষ্টা করবেন, তখন সে তার বাজে ম্যানিপুলেশন আপনার উপর সহজে চালাতে পারবে না। চালাইতে গেলে আপনি বলতে পারবেন, আপনারে তো আমি আগেই বলছিলাম, এই এই সমস্যা হইতেছে, এবং দেরীতে যে আপনি এপ্রুভাল দিছেন, এতে এই সমস্যা হতে পারে।
সোশ্যাল এক্সচেইঞ্জে যদি আপনি সত্যি ভ্যালু এড করেন কোন সম্পর্কে, এবং দেখেন, অপর পক্ষ ডাউনপ্লে করতেছে বা করতে পারে, তখন সৎ ভাবে স্পষ্ট যোগাযোগ করতে পারেন।
গডফাদারের এই দৃশ্যে বনাসেরা যখন বিচার নিয়ে আসে, তখন প্রথমে সে ডন কর্লিওনিরে টাকা দিয়া খুন করাইতে চায়। এতে ডন কর্লিওনি রেগে যান প্রায়, তিনি তারে বুঝাইয়া দেন, টাকা তার কাছে ম্যাটার না, তিনি টাকা নিয়া মার্ডার করা লোক না। তিনি বুঝাইতে যান, তিনি বোনাসেরার ফ্রেন্ডশিপ চান। বনাসেরা বুঝতে পাইরা রাজী হয়। সে যখন নত হয় তখন ডন রাজী হন তার মেয়েরে যারা মারছে তাদের শাস্তি দিতে।
বনাসেরারে তিনি যে একরকম হিউমিলিয়েট করেন, এর কারণ বোনাসেরা ডন কর্লিওনির ফ্রেন্ডশিপ ইগনোর করে গেছে এত বছর, সে তার কাছে আসে নাই, সে ভাবছিল আমেরিকায় সে সফল হইছে আমেরিকা তারে সব দিবে। কর্লিওনির মত খারাপ লোকের বন্ধুত্ব তার লাগবে না। দ্বিতীয়ত, আসার পরেও সে বন্ধুত্ব না চাইয়া, নত না হইয়া চাইছিল টাকা দিয়া কাজ করাইতে, সে ডনরে ডাউনপ্লে করতে চাইছে। এইটা ডন কর্লিওনিরে অপমান করা। এরে কাউন্টার দিতেই ডন তারে নত করান।
এবং পরে, খুবই ইন্টারেস্টিং এক কথা বলেন, কোনদিন, হয়ত সে দিন কখনো আসবে না, - আমি তোমারে বলব আমার জন্য কিছু করতে। এর আগ পর্যন্ত এই ন্যায়বিচাররে আমার মেয়ের বিয়ার দিনের উপহার হিশাবে ধরে নাও।
তিনি এইখানে ক্লিয়ারলি, সৎ ভাবে তার সাথে কমিউনিকেট করলেন। কারণ অবশ্যই তিনি তার জন্য বড় কাজ করতেছেন, এবং সে যেন এটা মনে রাখে, এবং এর প্রতিদানে কর্লিওনির জন্য কিছু করতে প্রস্তুত থাকে।
আজ এই পর্যন্তই। আগামী পোস্টে, ম্যানিপুলেশনের আরেকটা ধরণ নিয়া আলোচনা করব। সেই পর্যন্ত, ভালো থাকেন।