অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের হইচই ফিল্ম মন্দার দেখলাম। আর্টিস্টিক্যালি রিচ, পরিচালক অনির্বাণ তার পরিচালনার দক্ষতা দেখিয়েছেন, চমৎকার!
এখন, কয়েকটা ইন্দুর ধরা যাক।
শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ থেকে নেয়া গল্প, সেইখান থেকে গল্প নিয়ে পশ্চিমবাংলার একটা অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে প্রক্ষেপণ করা হইছে। তবে, আমি যখন দেখতে শুরু করি তখন ম্যাকবেথ থেকে নেয়া এইটা কেন জানি খেয়াল করি নাই।
প্রথমে গ্যাংস অব ওয়াসিপুর টাইপের কাশ্যপিয়ান ক্রাইম ড্রামা হবে ভাবছিলাম। পরে তান্ত্রিক এবং তার পোলা পেদো যখন বার বার আসতে লাগল, তখন মনে হইল, কীসের সাথে জানি মিল আছে। এবং বুঝা গেল ম্যাকবেথের সাথে। এই বুঝাটা না গেলে ভালো হইত। ম্যাকবেথের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গিয়া গল্প তার গতি হারাইছে।
এই জায়গায় একটা প্রশ্ন আমার, শেক্সপিয়র থেকে গল্প নিলে তার প্রতি পুরা বিশ্বস্ত থাকতে হবে কেন? এটা কি এই জিনিশ “শেক্সপিয়রিয়ান” বলে আলাদা শৈল্পিক মান পাইতে? এমন হলে তা ভুল। শেক্সপিয়র যাদের থেকে কাহিনী নিছিলেন, তাদের প্রতি কতটা বিশ্বস্ত থাকছিলেন? আর আর্টের ক্ষেত্রে, যত উইয়ার্ড জিনিশই হোক, ডাইনি আনেন বা প্রেতাত্মা, যা কইরা আপনি পার পাইয়া যাবেন, ও মানুষরে বিশ্বাস করাইতে পারবেন এইটা আর্ট, সেইটাই তো আর্ট, ওয়ারহলের সুরে বললাম আর কি। আমার মনে হয় এইখানে ওয়ারহল আর্ট করার কারেজ বুঝাইছেন।
গল্পের সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারে বলতে গেলে, মন্দার ও মন্দারের বউয়ের মধ্যে কে বেশি পাওয়ারফুল? মন্দার রাজা হবে বিশ্বাস করে নাই। তার বন্ধু, যারে সে নৌকায় নিয়া মারল, সে বলছিল, ইউ ক্যান টেইক অল দিজ ফ্রম ডাবলু। কিন্তু মন্দার বিশ্বাস করে নাই। ডাইনি বললেও তার বিশ্বাস হয় নাই। কিন্তু, এই জিনিশ যখন তার বউ তারে বলতে লাগল, তখন আস্তে আস্তে তার ভিতরে বিশ্বাস জন্মে।
লাকানিয়ান বা জিজেকিয়ান আলাপে বিশ্বাস এইভাবে কাজ করে। অন্য আরেকজন বিশ্বাস করতে হয়।
অন্য বিশ্বাস করতেছে মন্দার রাজা, সেই বিশ্বাস দেখে মন্দার বিশ্বাস করতেছে সে রাজা। এইরকম।
এইখানে অন্য, মন্দারের বন্ধু, ডাইনি, এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্দারের বউ লাইলি।
মন্দার ও লাইলির যে মিথস্ক্রিয়া এইটা ফেমিনিন ও মাস্কুলিন এনার্জির আন্তক্রিয়ামূলক কোলাবরেশন।
ফেমিনিন এনার্জি গডলি, ফলে সে দিশা দেয়। মাস্কুলিন এনার্জি আর্থলি, দেখবেন মন্দার এক্সারসাইজ করে, খুন করে, সে ভায়োলেন্ট লোক, কিন্তু তার দিশা নাই। তার একটা “ল্যাক” আছে, নাই একটা কিছু। এই জিনিশরে, আমরা ধরতে পারি পরিচালক তার পুরুষত্বহীনতার রূপকে দেখাইছেন। [ এই জায়গায় ইম্পটেন্সির অর্থ যে পুরুষত্বহীনতা, এইটার মানে কী? কেউ ইম্পটেন্ট হইলে কি সে পুরুষ না বা ফিমেলের ক্ষেত্রে সে বন্ধ্যা হইলে কি তার নারীত্ব থাকে না? এর আরেক সমার্থক ধ্বজভঙ্গ। সেই ধ্বজভঙ্গের অর্থ গিয়া দেখলাম পুরুষত্বহীনতারূপ ব্যাধী, ধ্বজী। অর্থাৎ অর্থগুলা নিজেদের নিজেরাই রেফারেন্স দিয়ে অর্থ তৈরি করতে চাইতেছে, ফলত আমারে ধ্বজ মানে কি জানার চেষ্টা করতে হইল। অর্থ পাইলাম পুরুষাঙ্গ, পতাকা, গৌরব ইত্যাদি। ফলে, আমার আগের প্রশ্নে আবার ফিরতেই হয়, ইম্পটেন্টদের পুরুষত্বহীন বলা কি ঠিক? যদি ঠিক হয়, তাইলে তো স্ত্রীসংগম করতে পারাটাই ও সন্তান উৎপাদন করতে পারাটাই পুরুষ হবার একমাত্র শর্ত হইয়া উঠে, এই দণ্ডরে এমন পুরুষত্বের মানদণ্ড বানানো ঠিক হয় কি না? ]
জিজেক ইসলামের ইতিহাস নিয়া যে লেখাটা লেখছিলেন, তিউনিশিয়ান সাইকোএনালিস্ট ফেথি বেনস্লামার বইয়ের উপর ভিত্তি স্থাপন করে, যেই বই আবার ফ্রয়েডের মোজেস ও একেশ্বরবাদের সাইকএনালিটিক লাইনে ধাবিত, সেই লেখায় জিজেক এই প্রসঙ্গটা তুলেন, নবীর নবী হইতে গেলে ফেমিনিন এনার্জি থেকে বিশ্বাস লাগে।
মন্দারে এই কাজ করে লাইলি।
যৌনতার রূপকে ফেমিনিন এনার্জির শক্তি কি দেখাইতে চাইলেন পরিচালক? চাইলেও হয় নাই। এই জায়গায় সচেতন প্রয়াস থাকলে, মন্দারের দ্বারা শেষের দিকে যে রেপ হয়, এইটা হইত না। আমরা শুধু স্ট্রং ফিমেল যৌনতা দেখতাম। লাইলিরে উপরে দেখানো হইছে কিছু সেক্স সিনে, আবার নিচেও দেখানো হইছে। এইটাও হইত না, সেইক্ষেত্রে তারে অলওয়েজ উপরেই দেখা যাইত। এবং আমি এইখানে অযাচিত পরামর্শক হইয়া এড করতাম এক জিনিশ, যা টপ অব দ্য লেইক সিরিজে দেখছিলাম। এক দৃশ্যে নাইকা এলিজাবেথ মস ও নায়কের অন্তরঙ্গ দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে, দেখা যায় নায়ক সরাসরি নাইকার ভ্যাজাইনা খাইতেছে। আর কিছু দেখায় নাই। এই জিনিশ আমার কাছে মনে হইছে ফেমিনিন পাওয়ার দেখাইতে, তারা জিনিশটারে রিভার্স করে দিছে, টপ অব দ্য লেইক অবশ্যই এক ফেমিনিস্ট সিরিজ। বাট ফেমিনিস্ট বলতে ফেমিনিজমের আন্দোলন ধরলে, কোন স্টেইজের আন্দোলন কেন্দ্রিক তা আমি বলতে পারব না। বিভিন্ন ওয়েব থাকায় এক নারীবাদ বলতে তো কিছু নাই, আপনে যদি আন্দোলনটার হিশাব করেন। মন্দারে লাইলির কাছ থেকে এমন কিছু একটা দেখলে এই ধারণা পোক্ত হইত যে, তার সেক্সুয়ালিটি ফেমিনিন এনার্জির প্রকাশে ব্যবহৃত হইছে।
পুলিস অফিসারের ক্যারেক্টারটা ভালো হইছে এইক্ষেত্রে, তার যৌনতা স্ট্রং ভায়োলেন্ট হিশাবে উপস্থাপিত হয় না, নিরীহ লুইচ্চা লুইচ্চা টাইপের, এটা ভালো হইছে।
এমনিতে এই ফিল্মে যৌনতার উপস্থাপন বেশি ও বিরক্তিকর। যৌনতার উপস্থাপন বিষয়ে বাঙালি পরিচালকদের একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তারা কি সমাজ বিবেচনা করে যৌনতা দেখাবেন নাকি দেখাবেন না? অর্ধেক দেখাব অর্ধেক দেখাব না, এমন হইলে তা বিরক্তিকরভাবে আন রিয়ালিস্টিক হয়। যেমন মন্দার ফিল্মে সেক্স সিন আছে, বাট কাপড় পরা অবস্থায়। যেহেতু দৃশ্যটা দেখানো হইতেছে রিয়ালিস্টিক একটা ভাব আনতে, তখন এইরকম চিত্রায়ন এই উদ্দেশ্যে বাঁধা।
এর চাইতে যৌনতার দৃশ্য কম দেখানো যাইত। এতে দর্শক বুঝত যে হইছে কিছু, কিন্তু বিরক্তিকর কিছু দেখত না।
ফিল্মে প্রতীকী, সারেয়াল কিছু দৃশ্য আছে, ভালো। বাংলা ওয়েব সিরিজগুলার মধ্যে আমি যা দেখেছি, এর মধ্যে আদনান আল রাজীব নির্মিত ইউটিউমার ফিল্মের কিছু দৃশ্যায়নে এমন আর্টিস্টিক এম্বিশন ছিল। গল্প ফেলুদা ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে তৈরি, এটাও ভালো। অর্থাৎ নব্য রীচ অবাঙ্গালী ভিলেন, খেয়ে ফেলতেছে বাঙালির ঐতিহ্য, আর তারে বাঁচাতে নায়ক ফেলুদার স্ট্রাগল, কলকাতার ফিল্মে বহু চর্চিত। সম্ভবত তাদের বাস্তবতা থেকেই আগত, যেহেতু ঐখানকার ব্যবসায়ীরা বেশীরভাগই অবাঙ্গালী।
ফিল্মটা দেখতে পারেন। অনির্বাণ ভট্টাচার্য একজন ভালো পরিচালক।
The post অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ‘মন্দার’ বিষয়ে appeared first on মুরাদুল ইসলাম.