কোন বাপ ও মা যখন নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় যৌনকর্ম করে সন্তান উৎপাদন করেন, আসলে তারা একটি বুদ্ধিমান প্রাণী তৈরী করেন। এই প্রাণীটির প্রতি তাদের মায়া মমতা তৈরী হয়, হাজার বছরের বৈবর্তনিক ইতিহাসের মধ্যে গমন করতে করতে মানবের ভেতরে এহেন মায়া মমতা প্রীতি বাৎসল্য ইত্যাদি তৈরী হয়েছে। এই হাজার হাজার বছর মা বাপের সাথে তার বাচ্চার ইন্টারেকশন, সেই বাচ্চা বড় হলে তার বাচ্চার সাথে তার, তার বাচ্চা বড় হলে তদীয় বাচ্চার সাথে তার ইন্টারেকশন……এভাবেই চলে আসছে।
মানুষেরা বাচ্চা আসলে নিজেদের জন্যই তৈরী করেন। বাচ্চা উৎপাদনরে যতই মহিমান্বিত করা হোক না কেন তা একেবারে স্বার্থহীন কাজ কখনোই বলা যাবে না। এর মাঝে একটা জিনতাত্ত্বিক স্বার্থ তো আছেই নিজের জিন ছড়াইয়া দেওয়া। এছাড়াও ব্যক্তিগত সুখ বৃদ্ধি, ভবিষ্যত নিরাপত্তা, ক্ষমতা ইত্যাদি নানা স্বার্থ থাকে।
আরেকটা বুদ্ধিমান এমন বস্তু মানুষেরা তৈরী করেন তা হল পোষা প্রাণীদের বাচ্চা। সরাসরি এক্ষেত্রে তারা ইনভলভ হন না, কারণ মানুষ ও পশুর যৌনক্রিয়ায় বাচ্চা সম্ভবত হয় না। তারা এক্ষেত্রে একই প্রজাতির বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর সাথে তার মাদী প্রাণীটির সংগম করান এবং বাচ্চা উৎপাদন করান। গরুর ক্ষেত্রে ধরা যাক। গরুর বাচ্চা হইলে মালিকের লাভ। বাচ্চা পাওয়া গেল, যে একটা সম্ভাবনাময় গরু, দুধও পাইলেন তিনি।
আবার আধুনিক পদ্বতিতে গরুরে যৌনসুখ পাইতেও দেয়া হয় না। সরাসরি ইনজেকশন মেরে দেয়া হয় উন্নত জাতের গরুর সিমেন। সেই গরু প্রেগন্যান্ট হয়, বাচ্চা দেয়। তার বাচ্চারে সরাইয়া নিয়া তার দুধ অনবরত নেয়া হয়। আধুনিক দুধ উৎপাদন ফার্মে এসব করে। মুরগীদের ক্ষেত্রে নানা হরমোন ও রাসায়নিক প্রদান করে তাদের ডিম দেয়া বাড়ানি হয়, অনবরত ডিম উৎপাদনে রাখা হয়, এবং অতি অবশ্যই স্বাধীন বিচরণ করতে দেয়া হয় না।
গরুরে অমানুষিক খাটানি, মহিষরে খাটানি বা ঘোড়ারে, গাধারে…এসব মানব সভ্যতার ইতিহাসের লগে জড়িত। মানুষে মানুষে মাইর লাগছে নানা স্বার্থজনিত কারণে, যুদ্ধ হইছে, কিন্তু মানুষেরা নিয়া গেছে ঘোড়া হাতি। মারা গেছে শত শত হাতি ঘোড়া। চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন হাতি বা ঘোড়া কত চাপে ছিল সেই সময়, সামনে তলোয়ার নিয়া আসছে দুধর্ষ চেঙ্গিস খানের বাহিনী। এর মাঝেও আরোহী যোদ্ধারে পিঠের উপরে নিয়া তারে আগাইয়া যাইতে হইত, কারণ পিঠের উপর যিনি বসে আছেন তিনি অকুতোভয় বীর, তার কথামত না চললে চাবকে পিঠের চাল তুলবেন।
সুতরাং, এইসব পোষা বুদ্ধিমান প্রাণীদের সাথে মানুষের যে আচরনের ইতিহাস তা বেশ ভালো না। বরং জঘন্যই বলা চলে। মানব সভ্যতার সবচাইতে বড় অপরাধই হইল এনিমেল ফার্মিং। এসব প্রাণীদের অধিকারই দেয় না মানুষ। তাদের তাচ্ছিল্য করে, হেলায় অবহেলায় মারে কাটে, যন্ত্রণা দিতে পছন্দ করে বেশীরভাগেই।
নিজের বাচ্চাদের সাথে যেরূপ মমতার সম্পর্ক মানুষের, যেরূপে তারা নিজের বাচ্চাদের জন্য একটা সুন্দর বিপদ আপদহীন ভবিষ্যত নির্মানের জন্য সদা ব্যস্ত, যেরূপে তারা নিজের সন্তানের অধিকার নিয়া সচেতন, এইরূপ নিজেদের পোষা প্রাণীদের জন্য দরদ তাদের হয় না। মোটকথা মানব সমাজে এই সংস্কৃতি চালুই হয় নাই।
বরং তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী সামনে আনে, ও মনে করে দুনিয়ার তাবত প্রাণীদের উপর তাদের অধিকার বিদ্যমান। সব প্রাণীরা আছে কেবল তাদের বিনোদন, আহার বিহারের জন্য।
যদিও হাজার বছরের বৈবর্তনিক ইতিহাস আছে মানুষের এইসব প্রাণীদের সাথে একসাথে থাকার, কিন্তু তবুও তাদের প্রতি মানুষের মনোভঙ্গির পরিবর্তন আদিকাল থেকে যৎসামান্য, বা বলা যায় আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজ উদ্ভবের পরে তা আরো খারাপ হইছে, খারাপতর হইছে শিল্প সমাজের পরে। এবং বর্তমান আধুনিক সমাজেও তা অব্যাহত আছে, দুনিয়ার সিংহ ভাগ মানুষ এতে হাইও তুলে না। বরং প্রাণী অধিকারের প্রশ্ন যেসব মানুষ তোলে তাদের অপ্রকৃতিস্থ বা উন্মাদ বলেই তারা মনে করে, কারণ এই রকম প্রশ্ন অন্য প্রাণীদের উপর মানুষের নিরঙ্কুশ অধিকারের গোলায় আগুন দেয়।
এখন মানুষ আরেক বুদ্ধিমান জিনিস নির্মান করছে। তা হচ্ছে রোবট। নিজেদের স্বার্থেই সে রোবট বানাচ্ছে। এইসব স্বার্থের মধ্যে আছে গৃহস্থালির কাজ দেখাশোনা, বোমা নিষ্ক্রিয় করা, যুদ্ধ করা ইত্যাদি অনেক অনেক কাজ।
মানুষ এখন দুশ্চিন্তিত এটা ভেবে যে রোবটেরা বুদ্ধিমান হবার পরে কি মানব সভ্যতায় আঘাত করতে পারে। এইরকম দুশ্চিন্তার কথা নিয়া হইছে অনেক ফিল্ম গল্প উপন্যাস। কিন্তু সে অনেক দূরের চিন্তা, কারণ রোবটেরা সেইমত শক্তিশালী হতে অনেক সময় লাগবে। আর মানুষেরা এই বিষয়ে এত সচেতন যে তারা এই ব্যাপারে সতর্কভাবে কাজ করছে। তারা চায় না কোনভাবেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরী করতে, কারণ তাদের কল্পনায় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বড় ভিলেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে যদি এমন আধুনিক রোবট তৈরী করা যায়, তারে এমন বুদ্ধিমত্তা দেয়া, যাতে তার মানুষের মত অনুভূতি-চেতনা তৈরী হয় তখন আসলে চিত্রটা কেমন দাঁড়াবে। সাধারণত প্রোগ্রামাররা ফেইক চেতনা বা চেতনার ভাব দিতে পারেন রোবটকে। অর্থাৎ, প্রশ্নের উত্তর দেয়, কাজ করে, দেখলে মনে হয় তার চেতনা আছে কিন্তু আসলে প্রোগ্রাম করা নির্দিষ্ট কিছুই পারে সে। আর মানুষের মত চেতনা দিতে হলে এমনভাবে প্রোগ্রাম করতে হবে যাতে মানুষের মত চেতনা তৈরী হবার একটা সুযোগ বা সক্ষমতা থাকে ঐ রোবটের। যদি এমন রোবট তৈরী হয়, এবং যদি সে মানবের মত সচেতনতা অর্জন করে ফেলে, তখন সে রোবটের প্রতি মানুষের আচরণ কেমন হবে?
মানুষ কি ঐ রোবটকে তার অধিকার দেবে?
ঠিক আছে রোবটের মস্তিষ্কটা হচ্ছে মেশিন, কিন্তু মানুষ ও অন্যসব প্রাণীর মস্তিষ্কটাও কি এক ধরণের মেশিন নয়?
যে রোবট তৈরী করা হলো, তা তো সন্তান তৈরী বা নিজের পোষা প্রাণীর বাচ্চা দুনিয়াতে আনার মত বিষয়।
নৈতিকভাবে বুদ্ধিমান, অনুভূতি যুক্ত স্বত্বাকে তার অধিকার দিতে হয়। যেমন নিজের বাচ্চাদিগকে মানুষেরা দেয়।
কিন্তু আমরা জানি অন্য প্রাণীদেরই মানুষেরা নিজেদের চাইতে ছোট ভাবে ও অধিকার দেয় না, এমনকী জ্ঞাতি শিম্পাঞ্জিদেরও দেয় নাই। ফলত, ইতিহাস থেকে দেখলে বলা যায়, এটা প্রায় নিশ্চিতই নিজেদের তৈরী রোবটরেও তারা কখনো অধিকার দিবে না। রোবটরে তারা ব্যবহার করবে যেরকম অমানবিক ভাবে অন্য প্রাণীদের তারা ব্যবহার করে থাকে।
সেই অনাগত অনুভূতি সম্পন্ন রোবটের এতে কষ্ট হবে। অবশ্যই কষ্ট হবে, যেহেতু তার অনুভূতি থাকবে মানুষের মত। যেহেতু আমার চেতনা-অনুভূতি আছে, তারো একইরকম থাকবে, সুতরাং তার কষ্টটা বুঝার চেষ্টা করি আমি। সেই অনাগত ও আসতে থাকা অনুভূতি সম্পন্ন রোবটের জন্য জন্য এখন থেকেই আমার সমবেদনা রইল। তার অধিকারের প্রতি আমার সমর্থনও জারি থাকল। মানব চেতন-অনুভূতি যদি তাকে দেয়া হয় তাহলে নৈতিক ভাবে অধিকারও তাকে দিতে হবে, এবং তার সাথে কীরকম ব্যবহার করা হবে না হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরী করতে হবে মানুষের। অন্যথায়, তাকে ব্যবহারের নৈতিকতাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
The post AI: চেতন-অনুভূতি সম্পন্ন রোবটের অধিকার appeared first on মুরাদুল ইসলাম.