সবচাইতে শক্তিশালী গ্লোবাল পাওয়ার হিসেবে আমেরিকার একচ্ছত্র রাজত্ব ছিল। এখনো আছে, কিন্তু আন চ্যালেঞ্জড অবস্থায় নাই। যেসব নতুন শক্তি তৈরি হচ্ছে, এবং আমেরিকার ক্ষমতার অংশে ভাগ বসাচ্ছে ও ভবিষ্যতে আরো ভাগ বসানোর লক্ষণ দেখাচ্ছে, চীন তাদের মধ্যে সবচাইতে সম্ভাবনাময়। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে হচ্ছে, তা কি স্থায়ী হবে? চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমেরিকার ভূমিকা কী হবে? নতুন পরাশক্তি তৈরি হওয়া ঠেকাতে আমেরিকা কী কী পদঃক্ষেপ নিবে? এখানে আমি ধরে নিচ্ছি, কোন পরাশক্তি বা সুপার পাওয়ার চায় না নতুন কোন দেশ পরাশক্তি হয়ে উঠুক, জন জে মার্শহেইমারের অফেন্সিভ রিয়ালিজম মাথায় রেখে।
পরাশক্তি বাংলা শব্দটি সুপার পাওয়ারের অনুবাদ। এসেছে শিবের পরাশক্তি থেকে, যার অর্থ শ্রেষ্ট শক্তি। হিন্দু পুরাণ মতে, শিবের তিনটি রহস্যের একটি হলো পরাশক্তি, যা শিবলিঙ্গের নীচের অংশ
একজন ইনভেস্টরের জন্য চীন প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রচুর সম্ভাবনা।
চীন বিষয়ক সম্ভাবনার কথাটা আলাপ করতে আগে আমেরিকার উন্নতি নিয়ে আলাপ করতে হবে।
আমেরিকার উন্নতি কি শেষ?
আমেরিকা বিষয়ে পেসিমিস্টিক কথাবার্তা প্রচলিত আছে, আমেরিকার গ্রোথ শেষ ইত্যাদি। এর উত্তরে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়ারেন বাফেটের এক লেখা প্রকাশিত হয় টাইম ম্যাগাজিনে। সেখানে তিনি বলেন আমরা এখন যে লাইফ লিড করতেছি, আমাদের সন্তানেরা তার চাইতে ভালো লাইফ লিড করবে। আমেরিকার যে জীবন মানের বড় উন্নতি হচ্ছে, তা সামনের অনেক জেনারেশন ধরে হতে থাকবে।
বিভিন্ন পোলে আশঙ্কা প্রকাশ হচ্ছে যে, আমেরিকার উন্নয়নের দিন শেষ। বলা হচ্ছে সাম্প্রতিক জিডিপি গ্রোথ ২%।
যদি আমেরিকার জনসংখ্যার গ্রোথ হয় ৩%, তাহলে এই ২% জিডিপি গ্রোথে কি ভবিষ্যতে জীবন মানের উন্নয়ন হবে?
ওয়ারেন বাফেট লেখেন, মৃত্যু সংখ্যা বাদ দিলে জনসংখ্যা গ্রোথ রেট হবে বছরে ০.৫%। বছরে এক মিলিয়ন মানুষ ইমিগ্র্যান্ট হিশাবে আসলেও তা হবে ০.৩%।
অর্থাৎ জনসংখ্যার গ্রোথ বাৎসরিক ০.৮%।
ধরই জিডিপি গ্রোথ ২% বছরে, ইনফ্ল্যাশন বাদ দিয়ে, এক্ষেত্রে পার ক্যাপিটা জিডিপি দাঁড়ায় ১.২%।
শুনতে সামান্য।
কিন্তু এক জেনারেশন, অর্থাৎ ২৫ বছরে ১.২% রেটে বর্তমান মাথাপিছু আয় ৫৯০০০ ডলার বেড়ে হবে ৭৯০০০ ডলার। এক জেনারেশনেই ২০ হাজার ডলার বেড়ে যাবে।
অর্থাৎ, আমেরিকার দিন শেষ না, বলা যায় শুরু।
চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে কী বুঝব?
এখন কেউ বলতে পারেন, বুঝলাম আমেরিকার উন্নয়ন হবে, কিন্তু আমি তো পড়া শুরু করছি চীনের উন্নয়ন জানতে। চীনের সাথে এর কি সম্পর্ক?
বাফেট যেইভাবে হিশাব করেছেন, একইভাবে চীনের হিসাবটা করি।
২০২০ সালে চীনের বার্থ রেইট ছিল বছরে ৮.৫%, মৃত্যুহার ৭.১%।
জিডিপি গ্রোথ এখন প্রায় ৭-৮%।
এখন চীনের পার ক্যাপিটা ১২ হাজার ডলারের কিছু উপরে।
চীন ৫ বছর পরপর তাদের ৫ বছরের প্ল্যান করে। গতবার এই প্ল্যানের মূল কথা ছিল, চীনকে তারা মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে যায় ২০৩৫ সালের মধ্যে। অর্থাৎ, তারা তাদের জিডিপি পার ক্যাপিটা ২৫-৩০ বছরের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার বাড়াতে চাচ্ছে।
উপরে ওয়ারেন বাফেট যে হিশাব দেখিয়েছিলেন, ১.২% রেইটে ৫৯ হাজার ডলার ২৫ বছরে কম্পাউন্ডিং হয়ে ৭৯ হাজার ডলার, বাফেটের এই আস্থার পেছনে ২৫ বছরে প্রায় ৩৫% আমেরিকান একোনমির গ্রোথ। কিন্তু চীনের একনোমিক গ্রোথ একই হিশাবে হয় ১০০-২০০!
২০৩৫ সালের মধ্যে জাতীয় একনোমি দ্বিগুণ করার এই লক্ষ্যের জন্য ৫% গ্রোথ দরকার ১৫ বছর ধরে, চীনের ভেতরের এবং বাইরের একনোমিস্টেরা এই লক্ষ্যকে বাস্তব সম্মত মনে করছেন না।
চীনের এই গ্রোথ কি কন্টিনিউ হবে?
উপরের জিডিপির হিশাব যদি হয় সম্ভাবনার দিক, তাহলে ঝুঁকির দিকের মূল স্তম্ভ হলো এই প্রশ্ন যে, চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি স্থায়ী হবে? এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভর করে, এবং নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনা বিশ্লেষণ, ও ভবিষ্যতের পরিস্থিতি কী হতে পারে তা অনুমানের মাধ্যমে একটা অনুমান নির্ভর উপসংহার সম্ভব।
জিডিপি গ্রোথ নির্ভর করে, ওই দেশে মানুষের কনজাম্পশন + ইনভেস্টমেন্ট + সরকারের ব্যয় + (রপ্তানী – আমদানী), এই ইকুয়েশনে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, চীনে ইনভেস্টমেন্ট বাড়ছে, জনসংখ্যার কনজাম্পশন বাড়ছে, বাইরের ইনভেস্টমেন্ট বাড়ছে, সরকারের ব্যয় বাড়ছে, আমদানির চাইতে রপ্তানী বাড়ছে। দীর্ঘ সময়ে এই অবস্থা পরিবর্তনের আশঙ্কা কম।
এবং এইখানে যা আশঙ্কা আছে, তা নির্ভর করে চীন ও আমেরিকার সম্পর্ক কীরকম হবে তার উপর।চীনের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক যদি খারাপ হয় সামনের দিনগুলিতে, তাহলে চীনের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে। আমেরিকার সাথে চীনের সম্পর্ক যত ভালো হবে, চীনের গ্রোথ ততো ভালো হবার সম্ভাবনা।
সুতরাং, এই প্রশ্ন এখন চিন্তার বিষয়, চীন ও আমেরিকার সম্পর্ক কেমন যাবে?
ইতিহাস থেকে দেখা যায় চীনের সাথে আমেরিকা কী রকম সম্পর্ক করতে চেয়েছে, বা, চীনকে আমেরিকা কীভাবে দেখেছে।
আমেরিকা ও চীনের সম্পর্কের ইতিহাস
আমেরিকা যখন ব্রিটিশ কলোনি ছিল তখন থেকেই চীনের পণ্য আমেরিকায় যেত, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মারফতে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় যে প্রতিবাদ হয়, যেখানে প্রতিবাদকারীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে যাওয়া ৩৪২ চেস্ট চাপাতা ফেলে দিয়েছিল, ১৭৭৩ সালের ঘটনা, বোস্টন টি পার্টি নামে পরিচিত।
আমেরিকা স্বাধীন হবার পরে চীনে যেত আমেরিকার বাণিজ্য জাহাজ। কিন্তু সেইসময়ে ব্যবসা ছিল একতরফা। চীন নিজেদেরকে অন্য জাতির চাইতে উচ্চ জাতের এবং সেরা মনে করত। তাদের সাথে ব্যবসা করতে হলে, তাদের কালচার, রীতি অনুযায়ী করতে হতো। যেমন রাজার সামনে নাকে খত দিয়ে সম্মান, কো টো ইত্যাদি। অর্থাৎ, তারা নিজেদের উচ্চ অবস্থান দেখিয়ে দিতে পছন্দ করতো। সামগ্রিকভাবে এই অবস্থাকে ট্রিবিউট সিস্টেম নাম দেয়া হয়েছে।
এবং, পণ্যের ক্ষেত্রে, বাইরের পণ্যে তাদের কোন চাহিদা ছিল না।
এইসময়ে আমেরিকা ও চীনের যে ব্যবসা সম্পর্ক ছিল, তা মূলত ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
দুই দেশের মধ্যে কোন চুক্তি, বাণিজ্য সন্ধি, বা কূটনৈতিক সম্পর্ক কিছুই ছিল না।
এক পর্যায়ে ব্রিটিশেরা ও আমেরিকানরা দেখতে পায় আফিমের চাহিদা আছে চীনে। আফিম দিয়ে ব্যবসা ব্যালেন্স করা সম্ভব। এই আফিম ব্যবসার খারাপ প্রভাব দেখে বন্ধ করতে চায় চীন। এতদিন চীন একতরফা বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে, এবং তাদেরকে অপমানজনক প্রথা মানতে বাধ্য করছে, আর এখন আফিম ব্যবসা বন্ধ করতে চাচ্ছে, ইত্যাদি কারণে প্রথম আফিম যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২, ১৮৫৬ – ১৮৬০) সংঘটিত হয়। দুইটাতেই চীন পশ্চিমা শক্তির কাছে পরাজিত হয়।
এবং এই পর্যায়ে তারা পশ্চিমাদের শর্তগুলা মেনে ব্যবসা চুক্তি করতে বাধ্য হয়। আফিমের ব্যবসা লিগ্যাল করে দিতে হয়, বন্দর খুলে দিতে হয়, ইত্যাদি। অর্থাৎ, চীন তার দেশের ভেতরে অনেক নিয়ন্ত্রণ হারায় ব্রিটেন আমেরিকা ফ্রান্সের কাছে। এই সময়ে প্রাচীন ট্রিবিউট সিস্টেম বিলুপ্ত হয়।
প্রথম আফিম যুদ্ধের পরে, নানকিং ট্রিটির মাধ্যমেই চীন ও আমেরিকার ব্যবসা চুক্তি শুরু হয়, যেই চুক্তিতে আমেরিকা এবং পশ্চিমা শক্তিরা এডভান্টেজ পায়। চীনের দিক থেকে এইসব চুক্তি ছিল অন্যায়, এবং অপমানজনক। অর্থাৎ, আফিম যুদ্ধের আগে একতরফা ছিল চীন, যুদ্ধের পরে পশ্চিমা শক্তি চলে যায় চালকের আসনে। চীন হয়ে যায় অধীনস্ত।
১৮৬০ সালের পর থেকে আমেরিকা চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক অপেক্ষাকৃত ন্যায় চুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তারা চায়, আমেরিকার উন্নতির জন্য চীনের শ্রম বাজার ব্যবহার করতে। অন্যান্য দেশের মত চীনকেও সমান সমান সুযোগ সুবিধা দিতে। এই পর্যায়ে তারা স্বীকার করে যে আগের চুক্তিগুলিতে চীনের সাথে অন্যায় করা হয়েছিল।
আমেরিকায় চাইনিজ ইমিগ্রেশন আরেকটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণ করতে ১৮৮০ সালে আমেরিকা নতুন আইন করে। দুই দশকের জন্য চাইনিজ ইমিগ্রেশন বন্ধ করা হয়। আমেরিকা এন্টাই-চাইনিজ রেসিজম বাড়তে থাকে। চীনেও বিদেশী বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে, বিশেষত খ্রিস্টান মিশনারীদের কার্যকলাপের জন্য। চীনে বক্সার রায়ট শুরু হয় ১৮৯৯ সালে। চাইনিজরা বিদেশী কূটনীতিক ও মিশনারীদের আক্রমণ করতে থাকে।
তখন আমেরিকার কাছে চীনের চাইতে জাপান ছিল আগ্রহের জায়গায়। চীনে জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়, আমেরিকায় এন্টাই-চাইনিজ রেসিজমের প্রতিবাদে ১৯০৫ সালে চীনে আমেরিকান পণ্য বর্জনের আন্দোলন হয়।
সেই সময়ে জাপান বিষয়ে আমেরিকা চীনের চাইতে বেশি পজেটিভ থাকলেও জাপানের সেনাবাহিনীর উন্নতি দেখে তারা এটাও সন্দেহ করতে থাকে পূর্ব এশিয়ায় জাপান তাদের বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে। সেই সন্দেহ থেকেই তারা চীনে তৈরি হতে থাকা জাতীয়তাবাদকে পজেটিভলি দেখে। শক্তিশালী চীন জাপানের পাওয়ার ব্যালেন্স করতে কাজে লাগবে, এই ছিল তাদের ধারণা।
জাপানকে কতটুকু সন্দেহ করা হবে, ও সেই অনুসারে চীনের দিকে কতোটুকু সুবিধা ও সাহায্যের হাত বাড়ানো হবে, এ নিয়ে আমেরিকার নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্যমত ছিল না।
সান ইয়াত সেনের হাত ধরে ১৯১১ সালে চীনের রাজবংশ শাসনের সমাপ্তি হয়। নতুন ধরণের সরকার পদ্বতি চালু হয়। সান ইয়াত সেনের জাতীয়তাবাদী দলকে আমেরিকা সাহায্য করতে রাজী হয় নি। তাদের অবস্থান ছিল, চীনকে সাহায্যে তেমন লাভ নেই, অন্যদিকে জাপানের মার্কেট অধিক লাভজনক। চীনের সাথে সম্পর্ক করতে গিয়ে জাপানের সাথে দ্বন্দের কোন মানে হয় না।
সুতরাং, সান ইয়াত সেন রাশিয়ার সাহায্য নেন।
শানদং প্রশ্ন
১৮৯৩ সালে জর্মনী চীনের শানদং প্রদেশের কিছু জায়গা দখল করে নেয়, দুইজন জর্মন মিশনারীকে হত্যা সংশ্লিষ্ট ঝামেলাকে কেন্দ্র করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৪ সালে জাপান এই অঞ্চল থেকে জর্মনীকে হটিয়ে দখল করে নেয়। ১৯১৫ সালে জাপান চীনকে অপমানজনক ২১ দফা দাবী চাপিয়ে দেয়, যেখানে তারা শানদং, ও মাঞ্চুরিয়ার আরো অনেক জায়গা দাবী করে বসে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চীন মিত্র শক্তির পক্ষে অংশ নিতে চাইলে, পাওয়ারফুল দেশগুলা এতে রাজী ছিল না। কারণ চীনের অবস্থা তখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সব দিক দিয়েই বাজে। ১৯১৪ সালে চীন ৫০ হাজার সেনা দিতে চাইছিল ব্রিটিশদের, ব্রিটিশরা রাজী হয় নি। কিন্তু ১৯১৬ সালে, যখন দেখা গেল যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে, তখন ব্রিটিশেরা চিন্তা করলো চীনের সাহায্য নেয়ার ব্যাপারে ভাবা যায়। তারা প্রস্তাব করে, কিন্তু জাপান চীনের সেনাদের সাথে একত্রে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
তখন চীন প্রচুর মানুষ পাঠায় ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়ায়, যুদ্ধের নানা কাজে সহায়তা করার জন্য, যেহেতু সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে না। চীন মিত্র শক্তির সাথে থাকতে চাইছিল, কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছিল আগের জর্মন অধিকৃত যেসব অঞ্চল এখন জাপান দখল করে রেখেছে, এগুলি ফিরে পাওয়া।
এপ্রিলের প্রথমদিক, ১৯১৭ সালে যুদ্ধে মিত্র পক্ষে যোগ দেয় আমেরিকা। আমেরিকা চাইনিজদের সমর্থন ও উৎসাহ দেয়, ফলে, যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি আলোচনায় নিজেদের দাবী পূরণ হবার আশায় চীন, আগস্ট ১৪, ১৯১৭ সালে জর্মনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
যুদ্ধ শেষ হলো নভেম্বর ১৯১৮ সালে। কিন্তু দেখা গেল পশ্চিমা শক্তি শানদং জাপানকে দিয়ে দিলো। চীন এতে প্রতারিত মনে করে। যদিও শানদং প্রশ্নে আমেরিকা চীনের পক্ষে ছিল, কিন্তু পশ্চিমা শক্তি ও জাপানের কাছে আমেরিকাকে নত হতে হয় এইক্ষেত্রে, যা আমেরিকার প্রতিও চীনের পাবলিক আস্থা নষ্ট করে। শানদং চীনের পাবলিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ, কারণ কনফুসিয়াসের জন্ম হয়েছিল এই প্রদেশে। অবশেষে ১৯২২ সালে আমেরিকার মধ্যস্থতায় চীন শানদং ফিরে পায়।
তাইওয়ান সমস্যা
আমেরিকা চীন সম্পর্কে আরেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তাইওয়ান। ১৯১০ সাল থেকে ১৯২০ এর মধ্যে চীনে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয় জাতীয়তাবাদীদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। এই সময়ে প্রায় নীরবেই মাও সেতুং এর কম্যুনিস্ট পন্থী দল সংঘটিত হতে থাকে, তাদের জনসমর্থন বাড়তে থাকে। ১৯২৭ সালে জাতীয়তাবাদী চিয়াং-কাই শেক কম্যুনিস্টদের দমন শুরু করেন। জাপান জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন দেয়।
আমেরিকাও জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন দেয়। ১৯৪৯ সালে জাতীয়তাবাদীদের গৃহযুদ্ধে পরাজিত করে মাও সেতুং এর পার্টি ক্ষমতায় আসে, এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এর জন্ম হয়।
চিয়াং, এবং জাতীয়তাবাদীরা পালিয়ে চলে যায় তাওইয়ানে।
চীন দাবী করে তাইওয়ান চীনের অংশ, এবং তারা ফোর্স প্রয়োগ করে দখল করার অধিকার রাখে। আমেরিকা এতে আপত্তি জানায়। রাশিয়া আমেরিকার শান্তিমূলক প্রস্তাব “দুই চায়না” নীতি গ্রহণ করার পরামর্শ দেয় চীনকে।
১৯৭২ সালে নিক্সন-কিসিঞ্জার শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দুই চায়না বাদ দিয়ে এক চীনের প্রস্তাবে মনোযোগ দেন, যেখানে তাইওয়ান চীনেরই অংশ। এই সময় থেকে চীন ও আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আবার শুরু হতে থাকে। আমেরিকা তাইওয়ানকে আলাদা দেশ হিসেবে অফিশিয়ালি স্বীকার করে না, কিন্তু আন অফিশিয়াল সম্পর্ক রাখে।
দূর্বল চীন যেভাবে পাওয়ারফুল হয়ে উঠল
চীনের ইতিহাসে দেখা যায় তারা সব সময় নিজেদের সেরা ভেবেছে অন্যদের চাইতে। বাইরের পণ্যের চাহিদা না থাকায় বাইরের সাথে ব্যবসায় অত আগ্রহী ছিল না। মাও সেতুং এর বিপ্লবের পরে চীন কম্যুনিস্ট ব্যবস্থায় ছিল। মাওয়ের পরে ক্ষমতায় আসেন দেং জিয়াওপিং। তিনি বুঝতে পারেন কম্যুনিস্ট সিস্টেম কাজ করছে না।
কিন্তু পশ্চিমা ভ্যালু এবং গণতন্ত্রেও চীনের বিশ্বাস ছিল না। তখন চীনের সামনে উদাহরণ হিসেবে আবির্ভূত হয় লি কুয়ান ইউ এর সিংগাপুর। চীন বুঝতে পারে পশ্চিমা গণতন্ত্র না নিয়েও ফ্রি মার্কেট একনোমিতে যাওয়া সম্ভব।
চীন সিংগাপুরের মডেল ফলো করে।
লি কুয়ান ইউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি প্রায় ত্রিশ বারের বেশি চীন ভ্রমণ করেন। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানান, হাজার হাজার চাইনিজ অফিসার সিংগাপুর ভ্রমণ করেছিলেন লি’র মডেল স্টাডি করতে।
চীনের মত অতি বৃহৎ দেশ, যার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস আছে, তার পক্ষে অন্যের ভ্যালু কালচার নেয়া সহজ না। এবং এত বড় দেশের একোনমিক রিফর্মের কাজ একবারে হবার নয়। কোন দেশেই একোনমিক রিফর্ম একবারে হয় না, এটা একটা প্রসেস। সময়ের সাথে সাথে কাজ চলতে থাকে।
লি কুয়ান তার পরামর্শ, সফলতা, কর্মপদ্বতি ও উদাহরণের মাধ্যমে, চীনের সামনে এক সফলতর রাস্তা দেখিয়েছিলেন। সেই সময়ে চীন আন্তর্জাতিক চাপে পড়লে, লি কুয়ান মধ্যস্থতা করতেন। পশ্চিমা শক্তিও তার কাছে পরামর্শ চাইত কীভাবে চীনকে ডিল করতে হবে এই বিষয়ে, আবার চীনও পরামর্শ চাইত কীভাবে সমস্যা থেকে উত্তরিত হতে হবে, এই বিষয়ে। চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক মডেল ও ফিউচার বিবেচনায় তাই গ্র্যান্ডমাস্টারকে স্মরণে রাখতে হবে। গ্র্যান্ড মাষ্টার লি কুয়ান ইউ প্রাচীন এক প্রবাদ মানতেন, যেটা দেন জিয়াওপিংও পরে ধারণ করেছিলেন, “বিড়াল সাদা না কালো বিষয় না, ইঁদুর ধরতে পারে কি না, তাই বিবেচ্য।”
মতাদর্শিক আন্ধামির বিরুদ্ধে লি কুয়ানের মূল মন্ত্র ছিল, আইডিয়াটা কি কাজ করছে? করলে ঠিক আছে, চালিয়ে যাও। না করলে বাদ দাও, অন্য আইডিয়া নিয়ে শুরু করো।
চীন বিষয়ে কিসিঞ্জারের ভাবনা
চীন বিষয়ে আমেরিকার বিখ্যাত কূটনীতিক, ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞ, সাবেক আমেরিকার সেক্ট্রেটারি অব স্টেইট হেনরি কিসিঞ্জার একটা বই লিখেছেন, অন চায়না নামে। সেখানে তিনি চীনের ইতিহাসের আলোকে তাদের সাইকোলজিক্যাল চরিত্র সম্পর্কে লিখেছেন। চীনের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ইতিহাসের রেকর্ড অনুযায়ী খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতক থেকে চীন একত্রিত হয়েছিল। তাদের বর্তমান ভাষা প্রায় ২০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের। এবং ইতিহাসের বেশীরভাগ সময়ে চীন ছিল সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান।
ভাষার প্রাচীন ইতিহাস তাদের ইতিহাসের চরিত্রদের সাথে যুক্ত করেছে, এবং সেই সংস্কৃতি ও সাহিত্য তাদের আত্মপরিচয়কে করে তুলেছে শক্ত।
কূটনীতিতে চীন দীর্ঘমেয়াদি লাভের পথ বেছে নেয় ঐতিহাসিক কারণেই। কারণ তাদের দুনিয়াকে দেখার ভঙ্গি হাজার বছর আগের সভ্যতার সাথে যুক্ত, ফলে দুনিয়া দুইদিনের মনে করে তারা স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ নেয় না।
চীন এগ্রেসিভ না, ট্যাকটিক্যাল। সান জু আর্ট অব ওয়ারে সাইকোলজিক্যাল ওয়ার, এবং যুদ্ধ না করে বিজয়ের পরামর্শ দিয়েছেন। চেয়ারম্যান মাও সে পদ্বতি অনুসরণও করে গেছেন।
চীনের প্রাচীন খেলা গো থেকে তাদের স্ট্র্যাটেজিক চরিত্র বুঝা যায়। এই খেলায় রিলেটিভ এডভান্টেজের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে হয়। অন্যদিকে পশ্চিমের জনপ্রিয় খেলা দাবায় প্রতিপক্ষকে পরাস্থ করতে হয় একেবারে বিনাশ করে।
কিসিঞ্জার পরামর্শ দিয়েছেন আমেরিকা যেন চীনের সাথে শীতল যুদ্ধে না জড়ায়। তার যুক্তি, অদক্ষ শ্রমিকদের মাধ্যমে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান হয়েছিল, এখন বেশি দক্ষ, অবস্থাপন্ন। ২০৫০ সালের মধ্যে চীনের অর্ধেকের বেশি লোকের বয়স হবে ৪৫ বছর। এই বিশাল বয়স্ক জনসংখ্যা নিয়ে চীন দখলমূলক মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিতে যেতে পারবে না।
কিসিঞ্জার প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন, আমেরিকা এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলি মিলে সম্মিলিত শক্তি হিসেবে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছেন, নিজেদের কমন পলিটিক্যাল গোল সামনে রেখে। দুনিয়ার স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য চীন ও আমেরিকার চল্লিশ বছরের পুরানো বন্ধুত্বের পথ মসৃণ হলে ভালো, মনে করেন কিসিঞ্জার।
চীন কি শান্তিপূর্ণ ভাবে উন্নত হতে পারবে, আমেরিকার ইতিহাস কী বলে?
চীনে যেরকম একনোমিক গ্রোথ হচ্ছে তা কি চলতে থাকবে, এটা যেমন প্রশ্ন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন চীনের পাওয়ারফুল হয়ে উঠা এই অঞ্চলে এবং গ্লোবাল ব্যবস্থায় কীরকম প্রভাব ফেলবে, ও চীন কি শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের উন্নতির যাত্রা অব্যাহত রাখবে? নাকি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী?
এটা একটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন।
অধ্যাপক জন জে মার্শহেইমারের বিশ্লেষণে, চীন শান্তিপূর্ণভাবে তাদের উন্নতির যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারবে না।
তিনি তার তত্ত্বে আগে পাঁচটা অনুমান ধরে নেন। প্রথম অনুমান, রাষ্ট্রই বিশ্ব রাজনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্ত্বা হিসেবে কাজ করে, তাদের উপরে আর কোন অথোরিটি নাই, কোন হায়ারার্কি নাই। যেমন জাতিসংঘ বা উচ্চ কোন ক্ষমতা। রাষ্ট্র সমূহ একটা নৈরাজ্যিক বা এনার্কিক সিস্টেমে কাজ করে।
দ্বিতীয় অনুমান, বিশ্ব ব্যবস্থায় যেসব রাষ্ট্র আছে তাদের সবারই কমবেশি মিলিটারি পাওয়ার আছে। কারো কম কারো বেশি। কিন্তু সবারই আছে।
তৃতীয় অনুমান, এক রাষ্ট্র কখনোই অন্য রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কী এ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারবে না, এবং অন্য রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য কী হবে, তা কখনোই জানতে পারবে না। মার্শহেইমার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোল্ড ওয়ার ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই সময়ে এক রাষ্ট্রের আসলেই উদ্দেশ্য কী ছিল, তা সম্পর্কে অন্য রাষ্ট্র শতভাগ নিশ্চিত ছিল না, এটা হওয়া সম্ভব নয়। যদিও মিলিটারি স্বক্ষমতা কেমন আছে এ সম্পর্কে বুঝা যায়, কিন্তু বর্তমান বা ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য কী হবে রাষ্ট্রের তা জানা অসম্ভব। মার্শহেইমার মানুষের লাইফের উদাহরণ দিয়ে বলেন, দুইজন মানুষ যখন বিয়ে করে, প্রায় ৯৯.৯৯% শতাংশ মনে করে উভয়েরই উদ্দেশ্য ভালো। কিন্তু দেখা যায় বিবাহ বিচ্ছেদের হার ৫০%। বিচ্ছেদের সময় প্রায়ই দেখা যায়, একে অন্যের প্রতি সহিংসও হয়ে উঠে। এই ফিউচার ইনটেনশন তথা ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য শুরুর সময় জানা সম্ভব হয় না। মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব না হলে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তো আরও অসম্ভব।
চতুর্থ অনুমান, রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য টিকে থাকা। একমাত্র গোল না, কিন্তু প্রধান গোল।
পঞ্চম অনুমান, রাষ্ট্রসমূহ র্যাশনাল একটর। তারা স্ট্র্যাটেজিক র্যাশনাল সিদ্ধান্ত নেয়।
অর্থাৎ, যেহেতু কোন হাইয়ার অথোরিটি নাই, এবং অন্য রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে না, সুতরাং গ্লোবাল ব্যবস্থায় রাষ্ট্র সমূহ একে অন্যকে ভয় পায়।
মার্শহেইমার বলেন, বিশ্ব অনেক বড়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা এই ভুল ধারণা ধারণ করে ফেলে যে, গ্লোবাল হেজিমন হওয়া সম্ভব। হেজিমন বলতে সুপারপাওয়ার ধরা যায়, আমেরিকা মনে করতে থাকে সে বিশ্বে একমাত্র সুপার পাওয়ার হতে পারবে। মার্শহেইমারের মতে এই ধারণা ভুল কারণ বিশ্ব অনেক বড়, এখানে আঞ্চলিক হেজিমন হওয়া সম্ভব।
আঞ্চলিক হেজিমন হতে হলে দেখতে হবে প্রতিবেশীদের মধ্যে চ্যালেঞ্জ করার মত কেউ যেন না থাকে। ওয়েস্টার্ন হেমিস্ফেয়ারে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করার মত কোন শক্তি ছিল না। আমেরিকার কোন ঝুঁকি ছিল না। এইজন্যই আমেরিকা পৃথিবীর সব জায়গার সমস্যাতে না গলিয়ে বেড়িয়েছে।
গ্লোবাল একমাত্র সুপার পাওয়ার হিসেবে টিকে থাকতে হলে দেখতে হবে, নিজের রিজিয়নে প্রতিবেশীদের মধ্যে ঝামেলা করার মত কোন শক্তি যেন না থাকে, অর্থাৎ রিজিওনাল হেজিমন হতে হবে। আবার দেখতে হবে, অন্যান্য অঞ্চলে কেউ যেন রিজিওনাল হেজিমন হয়ে উঠতে না পারে, অর্থাৎ তাদের যেন প্রতিবেশীদের সাথে ঝামেলা লেগে থাকে, যাতে তারা ঐদিকেই ব্যস্ত থাকে।
আমেরিকা তার উত্থানের সময় থেকে ন্যাটিভ আমেরিকানদের মেরেছে, জমি কেড়েছে, মেক্সিকো আক্রমণ করেছে, তাদের জমি কেড়েছে, কানাডা আক্রমণ করেছে, কানাডা পরে তটস্থ থেকেছে আরও আক্রমণের ভয়ে, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল দখল করে ফেলতো দাসপ্রথা বিরোধী অবস্থান শক্তিশালী না থাকলে। অর্থাৎ, পৃথিবীর প্রথম আধুনিক সুপার পাওয়ার আমেরিকা যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েছে তার শুরুর দিকে, তা আধুনিক সময়ে অভূতপূর্ব। এইসব আক্রমণ, শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমেই তারা আঞ্চলিক হেজিমন হতে পেরেছে। ওই সময়ের বড় শক্তি ব্রিটেনকে ওয়েস্টার্ন হেমিস্ফেয়ার থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে আমেরিকা, তাতে সফল হয়েছে। অন্যদিকে ব্রিটেন চায় নি আমেরিকা শক্তিশালী হোক, তারা চেয়েছিল সিভিল ওয়ারের সময় আমেরিকা দুইটা দেশ হয়ে যায়, এমনকী সাউথ সাইডের পক্ষে অংশ নেয়ার কথাও ভেবেছিল, ব্রিটেন ন্যাটিভ আমেরিকানদের সাথে বিরোধে ন্যাটিভদেরই সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু ব্রিটেন শেষপর্যন্ত সফল হয় নি।
এই ইতিহাস খেয়ালে রাখলে, চীনও চাইবে রিজিওনাল হেজিমন হতে। এটা না হলে তাদের গ্লোবাল ইনফ্লুয়েন্স স্থায়ী হবে না। অতএব, তারা চাইবে না তাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে তাদের চ্যালেঞ্জ করার মত কেউ থাকুক। এবং, চীন চাইবে সাউথ ইস্ট এশিয়া রিজিয়নে আমেরিকার ইনফ্লুয়েন্স কমাতে। চীনের ইতিহাসে, যখন তারা দূর্বল ছিল তখন পশ্চিমাদের কাছে, জাপানিদের কাছে নত হয়ে থাকতে হয়েছে, অপমানিত হয়ে থেকেছে। চীনের চাইতে কে আর ভালো বুঝবে শক্তিশালী হবার গুরুত্ব?
চীন রিজিওনাল হেজিমন হতে যা করা দরকার তা করবে। অর্থাৎ, প্রয়োজন হলে এগ্রেসিভ হবে। চীন অনুন্নত দেশগুলিতে যে ঋণ দিচ্ছে, সবচাইতে বেশি ঋণ দেয়া দেশে পরিণত হয়েছে, এই ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া তাদের গ্লোবাল ইনফ্লুয়েন্স প্রতিষ্ঠারই অংশ। এইড ডেটার প্রকাশিত পলিসি রিপোর্টে দেখা যায়, চীন ঋণের শর্ত হিশাবে চুক্তির শর্ত, এমনকি ঋণের ব্যাপারটাও কখনো গোপন রাখতে বলে। এবং এমন শর্ত রাখে, যদি জিওপলিটিক্যাল কারণে সম্পর্ক খারাপ হয় তাহলে তারা ঋণ বন্ধ করে দিতে পারবে।
চীনের রিজিওনাল হেজিমন হয়ে উঠার প্রক্রিয়ায় আমেরিকার ভূমিকা কী হবে? বর্তমান সুপার পাওয়ার হিসেবে আমেরিকা অবশ্যই চাইবে তার অবস্থান ধরে রাখতে। এইজন্য সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে যাতে চীন রিজিওনাল হেজিমন হতে না পারে। অর্থাৎ আমেরিকা চীনের প্রতিবেশীদের সাহায্য করবে। এইজন্যই এখন ভারতের সাথে আমেরিকার সু-সম্পর্ক।
এই তত্ত্বের কিছু কাউন্টার তত্ত্বও আছে, যেগুলি বিবেচনায় নিতে হবে চীনের উত্থান শান্তিপূর্ণ হবে কি না, এই ভবিষ্যৎ বিবেচনায়।
এক, সব বড় শক্তিরই পারমাণবিক অস্ত্র আছে। চীনের বড় প্রতিবেশী জাপান বা ভারতেরও আছে। এই অবস্থায় বড় সংঘর্ষ আত্মঘাতি হবে। অতএব বড় সংঘর্ষ হবে না।
দুই, একনোমিক ইন্টার ডিপেন্ডেন্স থিওরি, যা বলে এখন গ্লোবাল ব্যবস্থায়, এক দেশের সাথে আরেক দেশের ব্যবসা সংযোগের কারণে একে অন্যের উপর এত নির্ভরশীল যে, যুদ্ধ নিজের জন্যই ক্ষতিকর। লি কুয়ান ইউ চীনের উত্থান বিষয়ে মনে করতেন, উত্থান শান্তিপূর্ন হবে, তার রিজনিং এ একনোমিক ইন্টার ডিপেন্ডেন্স থিওরি ছিল। তিনি এও মনে করতেন, চীন যদি গণতান্ত্রিক হয় তাহলে চীনের জন্য ক্ষতিকর হবে, ভেঙ্গে যেতে পারে।
তিন, ডেমোক্রেটিক পিস থিওরি, যা মতে ডেমোক্রেটিক দেশগুলা পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করে না বা করতে চায় না। এই অবস্থানের পেছনে আর্গুমেন্ট হলো, ডেমোক্রেসিতে চেক এন্ড ব্যালেন্স থাকে, পাবলিক অপিনিয়নের গুরুত্ব থাকে, বিরোধী দল থাকে, সিভিল সোসাইটি তথা সুশীল সমাজের ভূমিকা, ইত্যাদি ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হয়। এই তত্ত্ব মতে, চীন ডেমোক্রেসিতে চলে গেলে আমেরিকার সাথে ঝামেলা হবে না।
চীনের একোনোমিক গ্রোথ যদি ধীর হয়ে যায়, তাহলে চীনের রিজিওনাল হেজিমন হবার সম্ভাবনাও থাকে না, সেইক্ষেত্রে কনফ্লিক্টের আশঙ্কাও থাকে না।
অনেক এনালিস্ট ধারণা করছেন সামনে চীনের একনোমিক গ্রোথের গতি শ্লথ হবে। ২০০৮ সালে প্রকাশিত বই নেক্সট হান্ড্রেড ইয়ারসে বিখ্যাত ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষক জর্জ ফ্রিডম্যান অনুমান করেন, আমেরিকা সুপার পাওয়ার হিসেবে বিদ্যমান থাকবে। ইউরোপ তার পূর্বেকার ডমিনেন্স ফিরে পাবে না। চীনের উন্নতি শ্লথ হবে। চীনের ভেতরকার দ্বন্দ্ব তীব্র হবে, এবং চীন হয়ত একদেশ হিসেবে টিকে থাকবে না। ফ্রিডম্যানের অনুমান ২০৮০ সালের দিকে আমেরিকার পাওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, এবং সেই চ্যালেঞ্জ শক্তভাবে আসবে মেক্সিকোর কাছ থেকে।
তার কথা, ভবিষ্যৎ জিওপলিটিক্যাল অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তথা দুনিয়ার ক্ষমতাচিত্র অনুমান করতে গুরুত্ব দিতে হবে কোন দেশের ভূপ্রকৃতি, তার প্রাকৃতিক সম্পদকে। এগুলির মধ্যে আছে খনিজ সম্পদ, পাহাড় পর্বত, প্রতিবেশী দেশগুলা কেমন, তাদের ধর্ম কী, রাজনৈতিক মতাদর্শ কী। ও শত্রু আছে কি না। এর সাথে অর্থনৈতিক অবস্থা, মানুষের প্রকৃতির উপর এর প্রভাব এবং প্রযুক্তিগত ইনভেশনকে মেলালে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্দিষ্ট অনুমান করা সম্ভব।
সাউথ চায়না সী তে চীনের ভূমিকা কী হবে?
মিলিটারি জার্নাল এবং থিংক ট্যাংকগুলির হিসাবে আমেরিকা ও চীনের সম্পর্ক যেসব মূল জিনিশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, তার প্রধান একটি হলো সাউথ চায়না সি।
সাউথ চায়না সিতে চীনের পদক্ষেপ কী হয় এর উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে চীনের সাথে আমেরিকা এবং অপরাপর পশ্চিমা দেশগুলির সম্পর্ক।
সাউথ চায়না সিতে বাণিজ্যপথে চীন যদি বাঁধা বা ব্লকেড তৈরি করে তাহলে নিচের ছবির লাল গোল অংশ দিয়ে কোন কার্গো জাহাজ, তেল ট্যাংকার যেতে পারবে না।
এতে জাহাজগুলিকে অনেক ঘুরে যাতায়াত করতে হবে, আর তাতে খরচ এবং সময় অনেক বেড়ে যাবে।
করোনা প্যান্ডেমিকের সময় দেখা গেছে গ্লবাল সাপ্লাই চেইনে কোন বিপত্তি তৈরি হলে এতে কত অসুবিধা এবং ক্ষতি হয়। উপরোক্ত ব্লকেড হলে সিংগাপুর এবং তাইওয়ান তাঁদের প্রায় সব আমদানি রপ্তানি থেকে ব্লক হয়ে যাবে।
এর অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রচুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াও সরাসরি আক্রান্ত হবে। নিচের ছবিতে দেখানো হয়েছে আনুমানিক কত জিডিপি শতাংশের ক্ষতি হবে,
ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার দুইজন গবেষক এইসব হিসাব করেছেন, তাদের রিসার্চ থেকেই ছবি দুইটি নেয়া।
উপরের ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন সাউথ চায়না সিতে এগ্রেসিভ মুভ নিলে চীনের কোন ক্ষতি হবে না। পক্ষান্তরে তাইওয়ান এবং সিংগাপুর ধ্বংস হবার মত দশায় চলে যাবে। তাহলে একটা ভালো সম্ভাব্যতা থাকে যে, সরাসরি মিলিটারি মাইর বা হাতাহাতি এড়িয়ে চীন সাউথ চায়না সমুদ্রে যেকোন এগ্রেসিভ পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে তাইওয়ান এবং সিংগাপুর তাদের শর্ত মানতে রাজী হবে নিজেদের বাঁচাতে।
এহেন পরিস্থিতি তৈরি হলে আমেরিকা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই চীনের এই ধরণের পদক্ষেপ হবে নিজেকে রিজিওনাল পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, যা আমেরিকা চায় না। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকার প্রতিরক্ষা মিত্র, সুতরাং আমেরিকা কি এগিয়ে আসবে। কিন্তু এইরকম ব্লকেড দেয়া কি সরাসরি এটাক হিসাবে দেখবে আমেরিকা?
এবং এখানে আরেকটা পয়েন্ট, এই ব্লকেড দিলে আমেরিকার কোন অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে না। তারা যদি এখানে জড়ায় তাহলে একমাত্র কারণ মিত্রদের সুরক্ষা এবং ঐ অঞ্চলে নিজেদের প্রভাবকে রক্ষা, ও চীনকে বাড়তে না দেয়ার জন্য।
অথবা, আমেরিকান নির্বাচনে প্রভাব ফেলতেও চীন সাউথ চায়না সমুদ্রে কোন পদঃক্ষেপ নিতে পারে বাইডেন প্রশাসনের শেষদিকে। ২০২৪ এ, তখন চীন সাউথ চায়না সিতে একটা ঝামেলা লাগিয়ে সহজেই প্রমাণ করে দিতে পারে বাইডেন দূর্বল, এবং আমেরিকান নির্বাচনে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। চীনের কাছে ইতিহাস থেকে একটি প্রমাণও আছে যে এই রকম জিনিশ কাজ করে, ১৯৮০ সালে ইরানীয়ান হোস্টেজ ক্রাইসিস প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ভরাডুবি ঘটিয়েছিল।
এই বছর, তথা ২০২২ সালের জুন মাসে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন ও আমেরিকা মিলে তৈরি করেছে পার্টনারস ইন ব্লু প্যাসিফিক , প্যাসিফিক সমুদ্রে চীনের তৎপরতা কাউন্টার দিতেই তাদের এই এক হওয়া।
চীনের ব্যবসা ব্যবস্থা কীরকম
চীনের ব্যবসা বাস্তবতায় সবচাইতে বড় শক্তি চীনের সরকার। কিন্তু ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানি, যেমন আলিবাবা, বাইডু, টেনসেন্ট, শাওমি এরাই ডিসরাপ্টিং শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। প্রথমদিকে চীনের অবস্থা ছিল, স্বস্তা শ্রম এবং বাজে কপি পণ্যের জন্য। ফ্রি মার্কেট একোনমির প্রতিষ্ঠিত কিছু নিয়ম তারা মানতো না, যেমন যারা কপি করতো, এবং এইসব কপি পণ্য বিক্রি করত আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায়। কারেন্সি ম্যানিপুলেট করে ইউয়ানের দাম কমিয়ে রাখতো ইত্যাদি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই অবস্থার বদল হয়েছে।
চীনে মাও সেতুং এর সময়ে ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানি ছিল না। তিনি ১৯৭৬ সালে মারা যান। চীন ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানিকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৮৮ সাল থেকে।
চীনে প্রচুর রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি আছে। গত কয়েক বছরের আগ পর্যন্ত, প্রাইভেট কোম্পানিগুলিকে সরকার উৎসাহ দিয়ে গেছে। সরকারি নিয়ম নীতির পরিবর্তন ও সহায়তার কারণে এই সময়ে অনেক ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানি তৈরি হয়। ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানির গ্রোথ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিদের চাইতে ভালো হয়ে থাকে, স্বাভাবিক কিছু কারণেই।
চীনের নতুন একনোমিক গ্রোথের সাথে ইন্টারনেট প্রযুক্তি ভিত্তিক কোম্পানি আলিবাবা, টেনসেন্ট, শাওমি, বাইডুর নাম জড়িয়ে গেছে। আলিবাবা ই কমার্স জায়ান্ট, এবং নানা দিকে তাদের ব্যবসা বিস্তার করে যাচ্ছে। আলিবাবার ফাউন্ডার জ্যাক মা’র অবস্থান ছিল দীর্ঘস্থায়ী প্ল্যানের বিরুদ্ধে। তার কথা হলো, প্ল্যান করে কিছু হয় না, অপরচুনিটি দেখতে পাওয়া ও কাজে লাগানোই গুরুত্বপূর্ণ।
যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই খালি পড়ে আছে, এইরকম অবস্থাতেই এই ধরণের অপরচুনিজম কাজ করে।
বিশ্লেষকেরা চীনে অপরচুনিটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘এস ও ও টি’ মডেল দেন।
প্রথম এস দিয়ে স্কেল। চীনে ব্যবসায় সফল হতে হলে আপনারে দ্রুত স্কেল করতে হবে। প্রচুর মানুষ, তাদের জীবন মানের উন্নয়ন হচ্ছে। দ্রুত বড় হয়ে তাদের কাছে না যেতে পারলে প্রতিযোগিতায় টেকা যাবে না।
ও দিয়ে অপেননেস। চাইনিজেরা বাইরের সাথে ওপেন হচ্ছে। তাদের পণ্য বাইরে যাচ্ছে, তারা যাচ্ছে, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট আসছে, তারা ইনভেস্ট করছে।
পরের ও দিয়ে, অফিশিয়াল সাপোর্ট, সরকার সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। নীতিমালা শিথিল করছে। চীনে বেশীরভাগ ব্যবসা চুক্তি আইনের চাইতে বেশি চলে ইনফর্মাল এগ্রিমেন্টে। এবং অফিশিয়াল সাপোর্ট না থাকলে চীনে ব্যবসা করা কঠিন।
টি দিয়ে, টেকনোলজি। ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন চীনের একনোমিতে ডিসরাপ্টিং ফোর্স নিয়ে এসেছে।
গত কয়েক বছরে যে সমস্যাটা হচ্ছে, অফিশিয়াল সাপোর্টের জায়গায় সমস্যা দেখা দিয়েছে চীনের প্রাইভেট কোম্পানিদের জন্য। মনোপলি, এবং আরো কিছু ইস্যু সামনে রেখে চাইনিজ সরকার বড় প্রাইভেট কোম্পানিদের উপর কড়া নীতিমালা আরোপ করে যাচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই, চীনের মতো অথোরিটারিয়ান দেশে সরকার চাইবে না কোন কোম্পানি এত বড় হয়ে যাক যে, সরকারকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে।
এই ক্র্যাকডাউন শুরু হয় ২০২০ সালের শেষের দিকে।
জ্যাক মা’র বিরুদ্ধে চীন সরকারের সাম্প্রতিক তৎপরতা
২০২০ এর শেষদিকের আগে জ্যাক মা চীনের সবচাইতে ধনী ব্যক্তি এবং একজন সুপারস্টার ছিলেন। একসময়ের এই শিক্ষক ও ইন্টারপ্রেটার আমেরিকা ভ্রমণ করে ইন্টারনেট দেখে মুগ্ধ হয়ে যান, ও দেশে গিয়ে শুরু করেছিলেন ইন্টারনেট ভিত্তিক বি টু বি বিজনেস, যা আজকের জায়ান্ট আলিবাবা।
২০১৯ সালে তিনি আলিবাবার এগজিকিউটিভ চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসর নেন। এই ঘোষণার অনুষ্ঠানটা ছিল ঝমকালো। ডায়মন্ডের চশমা, লেদার জ্যাকেট, উইগ পরে, ৬০ হাজার আলিবাবা কর্মীর সামনে ঝমকালো স্টেডিয়ামে জ্যাক মা ঘোষণা দেন, আমি পদ থেকে যাচ্ছি, কিন্তু অবসরে যাচ্ছি না। আমি কাজ করে যাব, থামব না।
আলিবাবা ও জ্যাক মা’কে নিয়ে সরকারের কোন সমস্যা ছিল না। ২০২০ এর অক্টোবরে জ্যাক মা সাংহাইতে এক মিটিং এ, চীনের কিছু টপ নীতি নির্ধারকদের উদ্দেশ্যে বলেন, চীনের ব্যাংকিং সিস্টেম বন্দকী মহাজনদের মত, এবং সরকারী নীতি ইনোভেশনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এর এক মাস পরে আলিবাবার ৩৩% মালিকানাধীন ফিনটেক এন্ট গ্রুপের স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্তির কথা ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, এটি হতে যাচ্ছিল পৃথিবীর সবচাইতে বড় আইপিও। চাইনিজ সরকার এটি আটকে দেয়।
তারপরে জ্যাক মাকে কিছুদিন পাবলিকের সামনে দেখা যায় না। এইসময় অনেকে ধারণা করতে থাকেন, চাইনিজ সরকার তাকে আটকে রেখেছে। এরপরে, তিনি পাবলিকের সামনে আসা কমিয়ে দিয়েছেন, তাকে মাত্র কয়েকবার পাবলিকের সামনে দেখা গেছে।
পানিতে বাস করে যেমন কুমিরের সাথে যুদ্ধ করা যায় না, তেমনি চীনে বাস করে চীনের সরকারের সাথে যুদ্ধ করে টিকা সম্ভব না। কারণ রুলস রেগুলেশন তো সরকারই বানায়। জ্যাক মা’র প্রতিষ্ঠান আলিবাবাকে একের পর এক আইন ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করে ফাইন করে যাচ্ছে চাইনিজ সরকার। আলিবাবা বাধ্য হয়ে মাথা পেতে নিচ্ছে, ফাইন পে করছে।
বড় বড় ফাইনে আলিবাবার প্রফিট কমছে, কিন্তু যেহেতু তাদের বিজনেস বড় তাই এতে খুব বেশি সমস্যা না। মূল সমস্যা ইনভেস্টরদের বিশ্বাস কমে গেছে। অক্টোবর ২০২০ এ আলিবাবার মার্কেট ক্যাপ ছিল ৮০০ বিলিয়ন ডলার, অক্টোবর ২০২২ এ এসে দাঁড়িয়েছে ১৭৮ বিলিয়ন ডলারে।
জ্যাক মা’র জন্য অবস্থা কতোটা খারাপ তা এই বছরের মাঝামাঝি সময়ের এক ঘটনা থেকে বুঝা যাবে। চীনের জাতীয় টিভি চ্যানেলে নিউজ প্রচার হলো, হংজু থেকে এক ব্যাকটিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ম নীতি অমান্য করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। যার নাম দুই শব্দে, এবং ডাক নাম মা।
এই খবরে মুহুর্তের মধ্যে আলিবাবার স্টক প্রাইস ৯% ফল করে। ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যায়, জ্যাক মা গ্রেফতার।
কিন্তু এক ঘণ্টা পর জাতীয় টিভি চ্যানেল জানায়, ভুল হয়েছিল, ঐ লোকের নাম তিন শব্দে।
জাতীয় টিভি চ্যানেল, যাকে প্রতিমুহুর্তে সেন্সর করা হয়, সেই চ্যানেল কেন এই নিউজ ঠিক করতে এক ঘণ্টা লাগাল? এবং জ্যাক মা নিজে, বা আলিবাবা কেন কিছু বললো না? বিশ্লেষকেরা ধারণা করলেন, এটা চাইনিজ সরকারের ওয়ার্নিং, জ্যাক মা এবং অন্যান্য বড় ব্যবসায়ীদের প্রতি।
ইনভেস্টরদের মধ্যে চাইনিজ কোম্পানি নিয়ে ভীতি চরম পর্যায়ে আছে, যার প্রমাণ হিসেবে গত কয়েকদিন আগের কথা বলা যায়। শি জিনপিং তৃতীয় বারের মত চীনের নেতৃত্বে আসলেন। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা কারণ দুই টার্ম ছিল লিমিট, তিনি তৃতীয় টার্মে আসলেন। টপ নেতৃত্বগুলাতে তার আস্থাভাজনেরা আছেন। এর প্রতিক্রিয়াতে চাইনিজ স্টকে ধ্বস নামে, ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ একদিনের পতন হয় ওইদিন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চীন ২০৩৫ সালে যে একনোমিক গ্রোথের টার্গেট ঠিক করেছে, সেখানে পৌঁছাতে আলিবাবা, টেনসেন্ট বা এইরকম জায়ান্ট ইন্টারনেট-প্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানিগুলাকে বাদ দিয়ে কি সেটা সম্ভব হবে? বা, চীনের সরকার যে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করেছে ইনভেস্টরদের জন্য, এতে ইনভেস্টমেন্ট কমে যাবে, সেইক্ষেত্রে তাদের একনোমিক গ্রোথের লক্ষ্য কীভাবে অর্জিত হবে?
আরেক প্রশ্ন, এই একনোমিক গ্রোথ অর্জন করতে, বিশাল সংখ্যক মানুষের খাদ্য এবং অন্যান্য চাহিদা নিশ্চিত করতে গেলে, পরিবেশের উপর যে চাপ পড়বে তা কি সামলাতে পারবে চীন? চীনের পানি ও বাতাস এখনই মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে, ও সিরিয়াস সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। চীনের কৃষিকাজ উপযুক্ত জমি মাত্র ১৫%, সেটাও নগরায়ণ ও শিল্পায়ণের চাপে লোপ পাচ্ছে।
চীনের আমেরিকা নির্ভরতা কেমন?
একোনমিক ইন্টার ডিপেন্ডেন্স থিওরি বলে অর্থনৈতিক ভাবে পরস্পর নির্ভরতা দুই দেশকে সরাসরি সংঘর্ষ থেকে দূরে রাখে। চীন ওপেন হবার পরে চীনে আমেরিকান ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট যেমন বেড়েছে, তেমনি আমেরিকায় চীনের এফডিআই বেড়েছে সময়ের সাথে সাথে। নিচের গ্রাফে আমেরিকায় চীনের ও চীনে আমেরিকান এফডিআই দেখানো হয়েছে, ইউএস চায়না ইনভেস্টমেন্ট হাবের সৌজন্যে,
আমেরিকার সবচাইতে শক্ত ও নির্ভরযোগ্য অর্থনীতির দেশ। ২০০৮ সালের গ্লোবাল ফাইনানশিয়াল ক্রাইসিসের জন্য দায়ী করা হয় আমেরিকার বিভিন্ন পলিসিকে, কিন্তু তাও আমেরিকার স্টক মার্কেট এবং ট্রেজারি বিশ্বের ইনভেস্টরদের কাছে সবচাইতে নিরাপদ জায়গা। চীনের একোনোমি গ্রো হচ্ছে কিন্তু এইরকম নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে নাই এবং শীঘ্রই পারবে না। ইউরোজনের অস্থিতিশীলতার জন্য তাদের একোনমিও নিরাপদ না। অর্থনীতির সাথে কার্যকর ইন্সটিটিউশন লাগে, যেটা আমেরিকার আছে, চীনের নাই।
আমেরিকার ট্রেজারি বিল/ ঋণের সবচাইতে বড় এক ক্রেতা হচ্ছে চীন। চীনের একোনমি রপ্তানী নির্ভর, চীনকে তার বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পণ্য ও সেবা রপ্তানীর উপর নির্ভর করতে হয়। রপ্তানিকারকেরা সাধারণত পেমেন্ট পায় ইউএস ডলারে। কিন্তু নিজের দেশে কর্মীদের বেতন, ব্যবস্থাপনা খরচ, জমানো ইত্যাদির জন্য লাগে ইউয়ান। তাই তারা ইউএস ডলার বিক্রি করে ইউয়ানে। এতে মার্কেটে ডলার সাপ্লাই বেড়ে যাবে, ও ইউয়ানের চাহিদা বেড়ে যাবে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ডলার ইউয়ানে কিনে নেয়। এটা করে যাতে ডলারের চাহিদা বজায় থাকে ও রেইট হাই থাকে। উল্লেখ্য, স্বাভাবিক ভাবেই চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনমত ইউয়ান ছাপাতে পারে।
ইউয়ানের দাম কমিয়ে না রাখলে চীনের রপ্তানিকারকদের খরচ বেড়ে যাবে, পক্ষান্তরে, কর্মসংস্থানে ক্রাইসিস দেখা দিবে। আবার এইভাবে ইয়ানের দাম ডলারের বিপরীতে কমিয়ে রাখার ফলে দেশে ইনফ্ল্যাশন বেড়ে যায়। যে হিউজ পরিমাণ ইউএস ডলার ফরেন রিজার্ভ হিশাবে জমা হয় চীনের, সেখান থেকে একাংশ তারা ইউএস ট্রেজারিতে ইনভেস্ট করে, রিস্ক ফ্রি রিটার্নের জন্য। অন্যভাবে বললে, চীন আমেরিকাকে ঋণ দেয়, যাতে আমেরিকা চীন থেকে পণ্য ও সেবা কিনতে পারে সেই ঋণ দিয়ে।
চীনে দূর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক সমস্যা আছে। শি জিনিপিং সরকারের প্রধান টার্গেট দুর্নীতি দূর করা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এই লক্ষ্য অর্জনে অনেক চেষ্টার পরেও ফল হয়েছে অল্প। কারণ যাদের দ্বারা দূর্নীতি বিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে, প্রায় সময় তারাই দূর্নীতিগ্রস্থ।
চীনে ইনোভেশনে এখনো সবল নয়। তাদের প্রাথমিক অগ্রগতি বাইরের প্রযুক্তি কপি করে সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গ্লোবাল মার্কেটে কোয়ালিটি পণ্যের কম্পিটিশনে চীন নিজস্ব ইনোভেশন ছাড়া টিকতে পারবে না। তাদের একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলিও দূর্বল। একাডেমিক রিসার্চ যা হচ্ছে, সেগুলিও মানসম্পন্ন নয়। নেতৃস্থানীয় একাডেমিক রিসার্চ প্রতিষ্ঠানগুলি আমেরিকায়। উচ্চশিক্ষার জন্য, এবং উচ্চ দক্ষতার জন্য চীনের ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকায় শিক্ষা অর্জন করছে। নিকট ভবিষ্যতে এই অবস্থা পরিবর্তন হবার নয়।
আমেরিকানরা কী পরিমাণ চাইনিজ স্টক বন্ড কিনছেন
চীনে আমেরিকান ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট যেমন বাড়ছে, তেমনি চাইনিজ সিক্যুরিটিতে আমেরিকান ইনভেস্টরদের ইনভেস্টমেন্ট বাড়ছে। যে দশটা দেশের স্টক বন্ড আমেরিকান নাগরিকদের সবচাইতে বেশি কেনা আছে, তাদের মধ্যে চীন অন্যতম। সি ফেয়ারার ফান্ডের থেকে প্রাপ্ত নিচের গ্রাফে এর উপস্থাপন আছে,
আমেরিকানরা এমনিতেই বিদেশী স্টক কম কিনেন, এই প্রবণতাকে হোম বায়াস নামে ডাকা হয়। পোর্টফোলিওর ২০% তারা বিদেশী স্টক রেখে থাকেন। সী ফেয়ারার ফান্ডের অনুমান, এর ২% চাইনিজ স্টক হতে পারে। যেহেতু চীন বিশ্বের কাছে ওপেন হচ্ছে, অতএব গ্লোবাল ইনডেক্সগুলাতে চাইনিজ স্টক যুক্ত হচ্ছে। চাইনিজ-আমেরিকান সম্পর্কের উন্নতি হলে বা অবনতি না হলে আরও বেশি সংখ্যক চাইনিজ স্টক আমেরিকানদের পোর্টফোলিওতে থাকার ভালো সম্ভাবনা আছে।
আপাতত উপসংহারঃ
এই লেখাটির বিষয় অনেক বড়, চীনের একোনমি ও ভবিষ্যৎ। এ সম্পর্কিত ডেটা পর্যাপ্ত নয়, চীনের পলিসি মেকিং এ কী হচ্ছে তা বিশ্ব সহজে জানতে পারে না। এবং সময়ের সাথে নানাদিকের নতুন নতুন ঘটনায় বিষয়টি প্রভাবিত হবে। তাই, এটা একটা অন গোয়িং রিসার্চের ভূমিকা হিসেবে পড়তে হবে। লেখায় অনেক জায়গায় অতি-সরলীকরণ করা হয়েছে, কারণ উদ্দেশ্য ইনভেস্টিং এর উদ্দেশ্যে চীনরে বা চীনের একোনমিরে, এবং এর সাথে যুক্ত অন্যান্য জিনিশরে বুঝা, সুতরাং, অতি-সরলীকরণ কাজে লাগলো কি না তাই বিবেচনার বিষয়। লেখাটিতে চীনের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্ভাবনা ও ঝুঁকির জায়গা দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। ইনভেস্টরদের জন্য ঝুঁকি ও সম্ভাবনা বুঝাটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাবনা, চীনের ওপেন হওয়া, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইভেট কোম্পানিতে সরকারের সহযোগিতা, বাড়তে থাকা কনজিউমার জনসংখ্যা, অদক্ষ কর্মীদের দক্ষ কর্মীতে পরিণত হওয়া, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের দিক থেকে উন্নয়ন। ঝুঁকির দিক, সরকার অথোরিটারিয়ান, বিশেষত বর্তনাম শি জিনপিং এর সরকার বিরোধীদের কোন স্থানই রাখে নাই, সরকার প্রাইভেট বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে নীতিমালা আরোপ করছে সাম্প্রতিক কালে, শিল্প ও উন্নয়নের চাপে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, জনসংখ্যার বয়স বাড়ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যার তিন ভাগের বয়স হবে ষাট বা তার অধিক, এদিকে ফার্টিলিটি রেইট কমছে এবং ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা।
—
এই পোস্ট কোন ইনভেস্টমেন্ট পরামর্শ নয়। ইনভেস্টিং, স্টক মার্কেট নানা ভ্যারিয়েবলের উপর নির্ভর করে, নিজের ঝুঁকি ইন্টিলিজেন্স, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে ইনভেস্ট করা উচিত।
-
বাংলাদেশ থেকে এই নিউজলেটারের পেইড ভার্শন যারা সাবস্ক্রাইব করবেন তারা এখান নিয়ম পাবেন। ডলারে সাবস্ক্রাইব বিদেশীদের জন্য।
চীন ও আমেরিকার সমন্ধে এত চমৎকার আলোচনা খুব কম পেয়েছি। রেফারেন্সগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক