আবার দিল চাহতা হ্যায় ফিল্ম নিয়ে লেখি। প্রচলিত ও পপুলার ফিল্ম নিয়ে লেখার সুবিধা হইল, সবার কমন নলেজে কাহিনী থাকায় যে কথাগুলা লেখতে চাইতেছি তা ওই কাহিনীর সূত্র ধরে বললে লোকে বুঝেন ভালো। আর অসুবিধা একটা আছে, এইসব ফিল্ম বেশী পপুলার হওয়ায় অনেক মানুষ এর চরিত্রগুলারে এতো "আপন" কইরা নেন যে, যে কোন কথারে ওই চরিত্র বা ফিল্মের বিরুদ্ধে ধইরা নিয়া নিজেরা আঘাত প্রাপ্ত হন। এমন দূর্বল ও অপরিণত চিন্তার লোকদের আগেই সতর্ক করতেছি, এবং তাদের বলতেছি কোন ফিল্ম বা চরিত্রই অত "আপন" হয় না যে আইডেন্টিটির লগে মিলাইতে ফেলতে হবে, ও ওইটার উপর 'আঘাতরে' নিজের উপর আঘাত ধরে নিতে হবে।
কেন জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা বা দিল চাহতা হ্যায় ফিল্মগুলা দীর্ঘসময় ধরে মানুষরে আপিল করতে পারে, এই প্রশ্ন নিয়া ভাবতে গেলে আসে ডরের কথা। মানুষের জীবনে অনেক ভয় থাকে। এই ফিল্মগুলা সেই ভয় নিয়াই কাজ করে ও সম্ভাবনা দেখায় যে, ভয়ের আগে আছে জিত, জীবনের আহবান।
এই সূত্রেই মানুষ এই ফিল্মগুলার লগে কানেক্টেড ফিল করেন। কত রকম ভয় মানুষের। যেমন ফিল্মের চরিত্র আকাশের ভয় ছিল প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে। সে সারফেইস লেভেল থেকে দুনিয়ারে দেখতো। নায়িকা প্রীতি জিন্তা তারে এখান থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। প্রথমে লাভ ফিল্ম দেখায়, কিন্তু দেখা যায় আকাশের জন্য ওই ডোজ খুব হালকা। তখন প্রীতি জিন্তা তথা ফিল্মের চরিত্র শালিনী সবচাইতে জটিল অস্ত্রে যায়, সে ক্লাসিক অপেরার মাধ্যমে আকাশের ইনার ফিলিং তারে বুঝতে শেখায়।
ক্লাসিক্যাল মিউজিক কীভাবে শুনতে হয়, এই বিষয়ে ২০০৮ সালে বেনজামিন জ্যান্ডার একটা লেকচার দিছিলেন টেড টকে, ওইখানে তিনি বুঝান, ক্লাসিক্যাল মিউজিক খালি শুনলেই হয় না, ফিল করতে হয়। এক পর্যায়ে তিনি দর্শকদের বলেন আমি যখন বি থেকে ই পর্যন্ত মিউজিক বাজাব তখন আপনারা এমন একজন লোকের কথা ভাববেন যারে আপনি অনেক অনেক বেশী ভালোবাসেন কিন্তু তিনি এখন আর বেঁচে নাই। এর মাধ্যমে তিনি দর্শকদের স্মৃতির লগে, অনুভবের লগে ক্লাসিক্যাল মিউজিকরে কানেক্ট করা শেখান, তথা মিউজিক ফিল করতে শেখান।
ফিল্মে শালিনীও আকাশরে বলে, তুমি চোখ বন্ধ কইরা ফিল করে কারে দেখতেছ। ওইরাতে আকাশ শান্ত হইয়া যায়, কারণ সে প্রথমবারের মত কনশাস হইতে থাকে নিজেরে নিয়া ফলে প্রগলভ অবস্থা তার আর থাকে না।
কিন্তু এটা থেকে আকাশের ভয়ের মুক্তি হয় না। সে শুধু ফিল করতে পারে, পরিবর্তিত হয়। তার ভয় দূর হয় যখন বাপ তারে সমর্থন দেন, বলেন মাইয়াটারে গিয়া বলো তোমার অনুভূতির কথা। পরে তার বন্ধু সমীর বলে ও শালিনীর আঙ্কেলও বলে, তখন সাহস পাইয়া সে আগায়।
এখন আমরা সিদ্ধার্থ বা সিডের দিকে যাই। তার কিন্তু ওই ইনার কনশাসনেস শুরু থেকেই আছিল। সে মূলত ফিল প্রধান, আর্টিস্ট, এইজন্য কম কথা বলে, এবং সেনসিটিভ। এই ফিল প্রধান হবার কারণেই সে তারা জশওয়ালের প্রেমে পড়ে, তার কাছে নিজের ফিলিংসটার প্রাধান্যই বেশী। সমাজের ঠিক করা কোনটা কী নিয়ম, এগুলা সে নিজের বিরুদ্ধে গিয়া মানে না। ভালো আর্টিস্ট সাধারণত এইরকম হয়ে থাকে, তাদের এজেন্সি থাকে খুব হাই।
এক দৃশ্যে দেখা যায়, যখন তারা প্রথম যায় সিডের বাড়িতে, তখন তার মা সিডরে বলেন, কোন এক আত্মীয়ের এক অনুষ্ঠানে যাইতে। সিড ওইখানে না করে দেয়, বলে সে বোর ফিল করে। এই দৃশ্য রাখা হইছে সিডের হাই এজেন্সি দেখাইতে।
কিন্তু একজন আর্টিস্ট, এবং নিজের অনুভবরে গুরুত্ব দিয়ে চলার সাহস থাকলেও ওইটা প্রকাশ করে এর মত বাঁচার সাহস তার ছিল না, বিশেষত প্রেমের বিষয়ে। সম্ভবত ফিল্মটা বেশ আগের কাহিনী এইজন্য, ২০০১ সালে রিলিজ হয়। আবার, তারে সমর্থন দেবার মত কেউ ছিল না।
তার মা তারে সমর্থন দেন নাই। আকাশের বাবা যেভাবে আগাইয়া আসছিলেন ছেলের সাহায্যে, অবশ্য শালিনী তারা জশওয়ালের মত হইলে নিশ্চয়ই আসতেন না তিনিও। একজন আর্টিস্টের মা হিশেবে, সিডের মা তো তারে চিনেন, তিনি সমর্থন দিতেও পারতেন। দেন নাই।
সবচাইতে মর্মান্তিক, তার ক্লোজ বন্ধু দুইটাও তখন বুঝতে পারে নাই। অপেরা শোনার পরে নিজের ফিলিং বুঝতে পারা আকাশ হইলে বুঝতে পারত, তখন সমর্থন দিত। কিন্তু আগের সারফেইস লেভেলে অবস্থান করা আকাশ বুঝতে পারে নাই, তাই ফান করতে গেছে। সিড তারে এইজন্য চড় মারে। এই চড়টা মারা হইছে দুই কারণে, এক, যেটা আমরা সকলেই বুঝি নোংরা মজা করতে গেছিল আকাশ। আর দ্বিতীয় কারণ, সিড বুঝতে পারে তারে সাহস দেবার, সমর্থন দেবার আর কেউ রইল না।
এইজন্যই ওই চড়ের পরে ঘটনা দ্রুত বদলে যায়। সিড অন্য জায়গায় চলে যায়, আকাশ অস্ট্রেলিয়া।
সব কিছুর মীমাংসা হয় ওই তারার মৃত্যুর পরেই বা হাসপাতালের ওই সময়েই। তখন যে আকাশ আসে, তা সিডের ফিলিং বুঝতে পাইরাই আসে, তখন সে ঠিকঠাক বুঝতেছিল সিড তারার প্রতি আসলে কী ফিল করে, যেইটা সে নিজেও ফিল করে শালিনীর প্রতি।
সিডের দিক থেকে ঘটনাটা ট্র্যাজেডি। একটা দৃশ্য আছে, তারা জশওয়ালরে সে লাভ করে ওইটা মারে বলার পরে, মা চেয়ারে বসে আছেন সিড গিয়া পায়ের কাছে বসে। খুবই দুঃখজনক আবহ তৈরি করা হয়, মনে হয় কে যেন মারা গেছে। কিন্তু আসলে কি এত দুঃখের কিছু ছিল এখানে? সিডের বসে থাকা খেয়াল করলে বুঝতে পারা যায়, এই দৃশ্য, এই আবহ প্রতীকী। এর মাধ্যমে দেখানো হইতেছে সিডের কেউ নাই, তার আবেগরে বুঝার কেউ নাই। বন্ধুরা তো আগেই বুঝে নাই। মা বুঝলেন না, ঐদিকে তারাও তাড়িয়ে দিল, বুঝেও বুঝলো না। আবার উল্লিখিত সবাই সিডের আবেগ যে বুঝেন না এমন না, এখানে বুঝেও বুঝেন নাই সামাজিক কারণে।
সিডের পায়ের কাছে বসে থাকার দৃশ্য, তার দৌড়, এইরকম কিছু দৃশ্যের জন্য এই ফিল্মটা সাধারণ ফিল্ম থেকে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। আমার বিচারে এই দৃশ্য এই ফিল্মের সেরা দৃশ্য।
এই তিন দিকের যে কোন একদিক থেকে বুঝটা আসলে, সিডের গল্পটা ভিন্ন হইত। তারা কেন বুঝল না বা বুঝতে চাইলো না? এই প্রশ্নটাই দিল চাহতা হ্যায় ফিল্মের মূল প্রশ্ন।
এক কারণ তারার মেলানকোলি, সে এক বিষাদগ্রস্থ মহিলা। সে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ছিল, এলকোহলিক ছিল। সে নিজেই ডুবন্ত, ফলে, সিডরে আশ্রয় দিবে, ধারণ করবে এই ক্ষমতা তার ছিল না। আর সম্ভবত, সে ছিল নার্সিসিস্ট। এই কারণে, সিডের মা যখন সিডরে বলতেছিলেন, ওই মহিলা তরে নিশ্চয়ই সিডিউস করছে ইত্যাদি, এইগুলা সে শুনে যে অপমানবোধ করে, ওইখান থেকে বের হতে পারে নাই। সে স্বাভাবিক হইলে সিডের ইমোশনরে বেশী গুরুত্ব দিত। অচেনা মহিলা, এবং সিডের মা হিশেবে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এমন বলবেন তা একরকম স্বাভাবিক।
একবার তারা বলছিল সে সিডরে ছবি আঁকতে দিব, তখন সিড দৌড়ে বাড়িতে যায়। আকার জিনিশপত্র নিয়া দৌড়ে ফিরে আসে। ওই দৌড়টা দেখানো হয়। তার আবেগটা বুঝাইতে। তারা সিডের আবেগরে দাম দিলে, সিড তারে ছাড়ত না।
তবে, হয়ত, তারার ভেতরে এই ভয় ছিল, সে নিজে জানতো এক ডুবন্ত নৌকা। তার ভয় ছিল সে তার উঠতে পারবে না তার এই হতাশা থেকে। তাই এর মধ্যে সিডরে টানতে চায় নাই।
এই ফিল্মে ভয়ের কথায় মানুষ আকাশের ভয়, শালিনীর ভয়, সিডের ভয় দেখবে, কিন্তু তারার ভয়টা হয়ত আড়ালেই থেকে যাবে। সে যদি তার ভয়টারে অতিক্রম করতে পারতো তাহলে গল্পটা ভিন্নরকম হতো।
আগের লেখাঃ দিল চাহতা হ্যায়
ফিল্মের ইউটিউব লিংকঃ দিল চাহতা হ্যায়