২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি এই অংশ লেখাঃ
বিল গেটস বার্গারের জন্য দাঁড়াইয়া আছেন, এটা দেখাইয়া মুনীর হাসানেরা ও তার মতোরা বলতেছেন, কী মহানুভবতা, বিনয়!
কিন্তু এই জিনিস আপনি খাবেন না দয়া করে।
বিল গেটস এতো টাকা কামাইছেন যে, ঐ লাইনে তার আর অর্জনের কিছু নাই। এবং মনে রাখবেন টাকা কেবল একটা রূপক কাগজ মাত্র, গেটস তার জিনিয়াসনেস বা অন্যসব দক্ষতা (এবং মায়ের ব্যবসায়িক কানেকশন, বন্ধু পল এলেনের সহযোগিতা) দিয়া এই রূপক কাগজ ধারণার উপরে চলে গেছেন বহু আগেই।
যে দামী বাড়ি গাড়ির পেছনে মানুষ দৌড়ে, সিম্পলি স্ট্যাটাস গেইমের জন্য, গেটসের এটার কি দরকার আছে? তিনি তার নামেই তো উচ্চ স্ট্যাটাস সারা দুনিয়ায়। প্রতিবেশী বা বন্ধুরে দেখাইতে দামী জ্যাকেট পরা তার লাগে না।
জীবনের এই পর্যায়ে এসে, এখন গেটসের কী দরকার?
মানবজাতির কাছে মহান হওয়া দরকার। গেটস বুদ্ধিমান লোক। বুঝতে পারছেন যে, মানুষের ইতিহাসে গ্রেট হইতে হলে সাহায্য করা লাগবে, বিনয় লাগবে। তিনি তার সেই উদ্দেশ্যেই এইরকম জীবন যাপন করতে পারেন, এটা ভাল। যে, দেখো হে মানবজাতি, আমি এক জিনিয়াস, টাকা কামাইছি বাট মানুষের জন্যই। ভালো, এতে অনেকের উপকার হয়।
কিন্তু এর সাথে অন্য সব লোকের তুলনা হয় না। এর দ্বারা অন্য লোকদের বিনয়ের সবক দেয়াও ভুল হয়। কারণ অন্যরা সাধারণ, তারা নিজেরা ‘স্ট্যাটাস’ হয় নাই। তারা মাটিতেই আছে। আপনি তাদের আর কোন মাটিতে নামাইতে চান?
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর এই অংশঃ
আজ দেখলাম আরেকটা ছবি ভাইরাল হইছেন। সেইখানে বাংলাদেশের বিখ্যাত ক্রিকেটার ও নড়াইলের এমপি মাশরাফি তার একজন বন্ধুর সাথে বসে আছেন। তার বন্ধু পেশায় একজন মুচি।
এই ছবি শেয়ার করে লোকজন বলতেছেন যে, মাশরাফি কত উদার। এত বড় স্টার হয়েও তিনি বন্ধুরে ভুলে যান নাই। এটারে তার বিনয়, মহানুভবতা বলে, তার সোশ্যাল ক্যাপিটাল বাড়ানো হইতেছে।
মাশরাফি তার অন্য পেশার বন্ধু, যেমন ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার ইত্যাদির সাথে ছবি দিলে কি এমন হইত? মিডলক্লাস কি তখন সেই ঘটনারে মহানুভবতা হিসেবে নিত?
নিত না।
মুচির সাথে তোলায় নিছে। কারণ মুচি পেশা হিসেবে তাদের কাছে নিচু। মুচি অস্পৃশ্য।
অস্পৃশ্যরে স্পর্শ করে ফেলছেন তাদের দেবতা, তাই তারা খুশি। দেবতার নব বন্দনায় মত্ত।
কিন্তু বন্ধু হিশাবে ধরলে, বন্ধু মুচি হইলেও বন্ধু, ডাক্তর হইলেও, এঞ্জিনিয়ার হইলেও। কারণ ব্যক্তি তো তারে বন্ধু হিশাবেই নিয়া নিছে।
মিডলক্লাস জনমানস আগেই ঠিক করে রাখে, বন্ধুর পেশা একটা মানে থাকতে হবে, টাকা থাকতে হবে ইত্যাদি। আবার, তাদের মনে এই ছদ্মভাবও থাকে যে, সব মানুষ সমান। এই ভাব তার নিজের ইগোর জন্যই দরকারী, কারণ সে তার চাইতে ধনীদের চাইতে ছোট নিজেরে ভাবতে চায় না।
মাশরাফির ছবি তাদের ভালো লাগছে, উচা সেলিব্রেটি লোক নিচাতে (তাদের হিশাবের) আইসা বসছে তাই। ঠিক যেমন বিল গেটসের বার্গার লাইনে দাঁড়ানোর ছবির ক্ষেত্রে হইছিল।
মিডলক্লাস যে শ্রেণী পেশা ঠিক করে বন্ধু বানায়, বা তাদের মনের যে এই বর্ণবাদ, এটা নিয়া আমার আপত্তি নাই। কে কারে কোন ক্রাইটেরিয়ায় বন্ধু বানাবে, এটা তার বিষয়।
এবং কে কারে কখন কেন বন্ধু হিশাবে বাদ দিবে, এখানেও আপত্তির জায়গা কম। মাশরাফির ছবি উপস্থাপনের ভেতরের যে বক্তব্য, তার খারাপ আরেকটা দিক হচ্ছে, মিডলক্লাস এটা বলতে চাইতেছে, এককালের বন্ধু মুচি হইলেও যেন তার লগে আড্ডা দেয়া হয়।
এমন প্রস্তাব ঠিক না।
কারণ এতে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সীমিত হয়ে আত্মীয়তায় পরিণত হয়।
কেউ তার একসময়ের বন্ধু গরীব হইলে, বা প্রায় যেকোন কারণেই, তারে অবন্ধু করতে পারবে। যেমন, মাশরাফি বা আরও অনেক এমন সেলিব্রেটি, তাদের অনেক বন্ধুদের অবন্ধু করেছেন, ইগনোর করেন। গরীব হইলেই মহানুভবতা দেখাইয়া তার পাশে বসতে হবে এমন দায় থাকলে এটা আর বন্ধুত্ব থাকে না, করুণামূলক আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়।
উপরন্তু, একজন পলিটিক্যাল লোক, যিনি এম্পি, তার জন্য সোশ্যাল ক্যাপিটাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এমতাবস্থায়, এই ধরণের সোশ্যাল ক্যাপিটাল অর্জনকারী ছবি কতটা বন্ধুত্ব আর কতটা নিজের স্বার্থে, এই প্রশ্ন থাকে অবশ্যই।
The post বিল গেটস ও মাশরাফির ছবির “মহানুভবতা” কোন জায়গায়? appeared first on মুরাদুল ইসলাম.