সুখপাঠ্য লেখা। আপনার ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে পড়া হলো। জীবনের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে আগাইতে পারলে তৃপ্তি পাওয়া যায়, জীবনের একটা মিনিং খুঁজে পাওয়া যায় - এইটা জানা ছিল। কিন্তু সেইটা যে পরিবার এবং আশেপাশের মানুষের মধ্যেই থাকতে পারে এইটা জানা ছিল না। প্রশ্ন হইল, অল্প মানুষই তো পরিবার এবং আশেপাশের বাইরে বড় কোন লক্ষ্য ঠিক করে না, কিন্তু তৃপ্তিটাও পায় না কেন? জীবনের মিনিং সে কিসে খুঁজতেছে সেইটা জানা নাই বলে?
- লেখক দারাশিকো, অডিসি যেই কারণে বড় হিরো লেখায় এই মন্তব্য করেছেন।
এর উত্তর এখানেও দিচ্ছি।
এই লেখার মূল এক পয়েন্টটা অডিসি এবং একিলিসের জীবনবোধের পার্থক্য। একিলিসও বড় হিরো, কিন্তু চায় অমরত্ব। সে বিশাল কিছু করে মহাকালে টিকে থাকতে চায়। অন্যদিকে, অডিসির এই ইচ্ছা নাই। সে ফোকাস দেয় তার আশেপাশের মানুষদের দিকে।
আমার কাছে এইজন্য অডিসি একিলিসের চাইতে বড়। সে বাস্তবে বাস করে। সে কমিটমেন্ট বুঝে, এবং সবচাইতে বড় কথা, সে ভালোবাসতে পারে। একিলিস ভালবাসতে পারে না। তার ক্রোধ, বীরত্ব এইগুলা প্রধান। মনে হয় রাজা প্রিয়াম যখন পুত্রের লাশ নিতে আসেন, তখনই আস্তে আস্তে একিলিস কিছুটা আর্দ্র হইতে থাকে।
যাইহোক, এখন আমাদের দিকে তাক করা যাক। প্রশ্ন আমি যেভাবে বুঝলাম, অধিকাংশ লোকই পরিবার ও আশপাশের বাইরে বড় কোন লক্ষ্য রাখে না, তাহলে কেন তৃপ্তি পায় না?
লক্ষ্য নিয়া বলতে গিয়া একটা ছোট উদাহরণ দেই নিজেরে নিয়া। আমি কেরিয়ার, টাকা ইত্যাদি কিছু বাস্তবিক সমস্যা নিয়াও লেখি। আমার যে মূল লেখালেখি তার দিকে দৃষ্টি দিয়া অনেক শুভানুধ্যায়ী বলছেন, এইসব ছোট বিষয়ে লেইখা টাইম নষ্ট করতেছি। দুয়েকটা ফালতু মূর্খরেও দেখছি, বলতেছে মোটিভেশন দিতেছি ইত্যাদি।
কিন্তু এইগুলা লেখার স্বপক্ষে আমার লজিক কী?
অডিসির লাইফ থেকে নেয়া লজিক। আমি একিলিসরে অনুসরণ করি না।
আমি সাহিত্যে যা করে যাব, তাতে সম্ভাব্যতার বিচারে একটা হাই চান্স আছে যে লেখাগুলা টিকবে, মানুষ পড়বে। কিন্তু এই টিকা বা অমরত্ব আমার কাছে আকাঙ্ক্ষিত নয়। মিনিংলেস।
বরং, আমার প্যাশনেট ক্রিয়েটিভ কর্ম নিজের আনন্দের জন্য, নিজের ক্রিয়েটিভ এনার্জিরে প্রকাশের জন্য। মানুষ পড়লে, ভালো বললে আনন্দ লাগে। একইসাথে মানুষের উপকার করার তাড়না থেকে যদি তথাকথিত ছোট জিনিশগুলা নিয়াও লেখতে হয়, তাতে আমার আপত্তি নাই।
এক্ষেত্রে ছফার এই কথা প্রভাবিত করেছে কি না জানি না। কিন্তু এটারে আমার সাইটে ঝুলাইয়া রাখছিলাম।
আমি সাধারনত ৩ টি কারণে লিখি। মানুষের কল্যান করার উদ্দেশ্য যদি থাকে, তখন লিখি। যদি আর্টিস্টিক কিছু সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য থাকে, তখন লিখি। আর যখন কোন কিছু প্রতিবাদ করার ইচ্ছা থাকে, তখন লিখি। - আহমদ ছফা; ডিসেম্বর, ১৯৯৩।
আমি কি জানিনা, চ্যাট জিপিটি দিয়া কেমনে জব এপ্লাই করতে হয়, কিংবা, কীভাবে ধনী হবেন, এই লেখাগুলা দার্শনিক ক্রিটিক্যাল লেখালেখির দুনিয়ায় কোথায় অবস্থান করে? জানি। এই লেখাগুলা আমার দার্শনিক-ক্রিটিক্যাল লেখা না, ওইরকম লেখা তো আছেই, লেখবই। কিন্তু এই যে এগুলা আমি লেখতেছি, এই এপ্রোচটাই একটা দর্শন চর্চা। মূর্খরা বেশ হইলে তত্ত্ব আউড়াতে পারে, এইটারে বুঝা ও কাজে লাগানো তাদের কাছে অচেনা, ফলে ধরতে পারে না।
মহাকালের গর্তে বড় এক কুমির হয়ে বসে থাকার জন্য আমার কাজ হইতে পারে না। কারণ সুমেরীয় বা মায়ান সভ্যতার মহান থিংকার বা লেখকদের আমরা এখন চিনি না। ইন দ্য লং লং রান, কিছুই টিকবে না। মূর্খরাও না, জ্ঞানীরাও। তাই গুরুত্বপূর্ণ হইল, উপস্থিত মুহুর্তে আমি আমার মেধা প্রতিভা স্কিল দিয়া মানুষের জন্য কী করে যাইতে পারলাম।
অডিসির কাছে অমরত্বের সুযোগ ছিলো, ক্যালিপসোর দ্বীপ, ইত্যাদিতে পেনেলোপির চাইতে সুন্দর নারি-হাফ দেবী ইত্যাদি ছিলো তার জন্য। কিন্তু সে কেন তাহলে ইথাকায় ফিরে যেতে চাইলো, এইটা হচ্ছে আরেক মূল প্রশ্ন।
অধিকাংশ লোকরে আপনে এই সুযোগ দেন, দেখবেন পরিবারের প্রতি তার কমিটমেন্ট কেমন।
অডিসির এই কমিটমেন্ট হইল তার লাভ, যেইটা দিতে হয়। আলা বাদিয়্যু যেমনে বলেন,
"Love is not a feeling, it is an action. It is a way of being in the world, of relating to others and to oneself. It is a commitment to the other, to their happiness, to their freedom."
আমরা এখন বাস করতেছি যে ওয়েস্টার্ন চিন্তার সময়ে, সেটি বলে লাভ থেকে প্যাশন সরাইতে হবে। রিস্ক নেয়া যাবে না। ফলিং ইন লাভ থেকে ফলিংটা বাদ দিতে হবে। কেবল নিতে হবে এনজয়মেন্ট। যেমন কনজিউম করার সময়ে আধুনিক কনজিউমার খুঁজে ক্যালোরি ছাড়া চিনি।
সাম্প্রতিক ডিজিটাল ধর্ম গুরু ন্যাশ সাহেবের ভিডিওতেও দেখলেন আধুনিক সমাজের এই সম্পর্ক দর্শন। তারা কতো ক্যাক্লুলেটিভ সব কিছু নিয়া। তার ভিডিওতে ইমোশন পাইবেন, কিন্তু লাভের প্যাশন, অযৌক্তিকতা পাইবেন না। কি সুন্দর যুক্তি দিয়া বিচার করে, ঠিকঠাক বুঝে শুনে দুইজন সাইকোলজিস্ট সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন দেখবেন।
এইটা আরও বড় এক করুণ দশা এখনকার মানুষদের। একিলিসের যে ক্রোধ, ওইটাতেও প্যাশন ছিল। তার অমরত্বের যুদ্ধে জীবনের রিস্ক ছিলো। যেমন, অডিসির পেনেলোপি, তার পোলা ও ইথাকার জন্য ভালোবাসায় অযৌক্তিকতা ছিলো, রিস্ক ও স্ট্রাগল ছিলো।
কিন্তু এই আধুনিক সমাজ সব কিছুরে প্যাশন ফ্রি করতে চায়। সব ক্যাক্লুলেটিভ।
এইজন্য প্যাশনেটলি কেউ আল্লারে মানতেছে, প্রেম করতেছে বা ক্রিয়েটিভ কাজ করতেছে, এটা এই আধুনিক সমাজের সহ্য হয় না। তার কাছে হিশাব প্রোডাক্টিভিটির, এইখানে কেমন লাভ হচ্ছে, কীরকম টাকা আসবে এখান থেকে।
মানুষের লাইফে এই টেন্ডেন্সি, যেইটা ন্যাশ দেখাইলেন, তা এন্টাই-লাভ, এন্টাই-রিলেশনশিপ।
অডিসির লাইফের শিক্ষা এই ন্যাশ এবং আধুনিকতার শিক্ষার বিরুদ্ধে।
এবং আপনার প্রশ্নের শেষ অংশ, যার মধ্যে উত্তর আছে কিছুটা, জীবনের মিনিং সে কিসে খুঁজতেছে সেইটা জানা নাই বলে?
সে কীসে মিনিং খুঁজে তার জানা নাই, একটা। আরেকটা হইল, পরিবার বা আশপাশে সে তো লক্ষ্য ঠিক করে নাই, ওইগুলাতে চাপে পড়ে করতেছে। তার ভালোবাসা কই খোঁজ নেন, তার প্যাশন কই? এইগুলাতে পাবেন না।
আর উপরের ন্যাশদের ইনফ্লুয়েন্স, আধুনিক সমাজের নানা মাধ্যম মারফতে তার এই সম্পর্ক দর্শনের প্রচার তো আছেই। সে যাবে কোথায় ইনফ্লুয়েন্স হওয়া ছাড়া, তার ডেজায়ার তৈরির মেশিনে ছড়ি ঘুরাইতেছে ইনফ্লুয়েন্সার মিডিয়া। তাই, সুখ ও শান্তি সে পাবে না।
একটা ছোট লেখায় জীবনের অনেকগুলো কন্সেপ্ট আর দর্শন একই সূত্রে যেভাবে শব্দ দিয়ে, চিন্তাশীলতা এবং উপলব্ধি দিয়ে গাঁথালেন সত্যি অসাধারণ!
অরিজিনাল একটা দর্শন পেলাম!
আন্তরিক ধন্যবাদ!